X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষার বিপদ-আপদ

রেজানুর রহমান
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৫৭আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৪৬

রেজানুর রহমান ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোনও দেশ স্বাধীন হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইর‌্যা নিতে চায়... এই ছিল সতর্কবাণী। তারপর মায়ের মুখের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে গোটা দেশে যে গণ-আন্দোলন শুরু হয় মূলত তারই পথ ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

কিন্তু মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান এখন কোথায়? যে ভাষার জন্য একটি দেশ স্বাধীন হলো তার যথাযোগ্য মর্যাদা কি দিতে পারছি আমরা? ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমরা অতিমাত্রায় উচ্চকিত হই। বিষয়টি অনেকটা এরকম- ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্মমাস! এক অর্থে জন্মদিনও বটে। আর তাই জন্মদিন পালনের ব্যাপারেই আমাদের যত দৌড়ঝাঁপ, হৈ চৈ... ফেব্রুয়ারি চলে যাবে, ভুলে যাবো মাতৃভাষার গুরুত্ব। যেমন, বৃদ্ধ বাবা-মাকে সারা বছর অনেকেই ভুলে থাকি আমরা। তবে তার জন্মদিনে ঠিকই ফুল নিয়ে হাজির হই। হ্যাপি বার্থ ডে বলি! আনন্দ করি, হৈ হুল্লোড় করি। ভালো খাবার খাই। তারপর যে যার মতো চলে যাই। অযত্ন অবহেলায় ফুল পড়ে থাকে। মা-বাবার অসহায় মুখোচ্ছবি দেখি না আমরা। দেখার প্রয়োজনও মনে করি না।

প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার বর্তমান অবস্থা মা-বাবার এই গল্পের মতোই। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ১৯৫২ সালে রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিকসহ নাম না জানা আরও যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা শহীদ মিনারের বেদিতে ফুলের মালা  দেবো। কী যে আবেগ, কী যে মায়া ছড়াবো আমরা। কিন্তু শহীদ মিনারের বেদিতে ফুলের মালা দেওয়ার পর্ব শেষ হলে ফুলগুলো কি সত্যিকারের মর্যাদা পায়? শহীদ মিনারে ফুলের অর্ঘ্য দেওয়া পর্যন্ত কত যে শ্রদ্ধার আনুষ্ঠানিকতা। জুতা পায়ে শহীদ বেদিতে ওঠা যাবে না। অথচ ফুল দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষে জুতা পায়েই ফুলকে দলাই মালাই করি, তখন একবারও কি শহীদদের কথা মনে হয় না? মাতৃভাষার জন্য মায়া জন্মায় না?

বলছিলাম মায়ের ভাষার কথা। অর্থাৎ বাংলা ভাষার কথা। পৃথিবীর জনসংখ্যা অনুপাতে বাংলা ভাষার অবস্থান এখন ষষ্ঠ স্থানে! বাংলা ভাষার কথা উঠলেই বাংলাদেশের কথা ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশে কি বাংলা ভাষা এখন যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছে? পরিবেশ পরিস্থিতি কী বলে? কয়েকটি চিত্র তুলে ধরতে চাই আপনাদের সামনে।

ভাষা টিকে থাকে চর্চা ও পরিচর্যার ওপর। আমরা কি সঠিক অর্থে মাতৃভাষার চর্চা করি? ভাষা পরিচর্যার বাস্তব অবস্থাটা এখন কেমন?

কয়েক দিন আগে একটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেলে গিয়েছিলাম। আড্ডা টাইপের অনুষ্ঠান। নাচ গানের পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। অনুষ্ঠানে যারা উপস্থিত ছিলেন সবারই মাতৃভাষা বাংলা। অর্থাৎ সবাই বাঙালি। অথচ পুরো অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করা হলো ইংরেজি ভাষায়। এই অনুষ্ঠানটি বাংলায় উপস্থাপন করলে খুব কী ক্ষতি হতো?

করোনায় বিয়ের অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই গান নাচ অনিবার্য। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখলাম অনেক বড় মঞ্চে সাংস্কৃতিক পর্বের পুরোটাই হিন্দি ভাষার গান ও নাচে ভর্তি। এই অনুষ্ঠানটি বাংলায় হলে কি এমন ক্ষতি হতো?

বেশ কিছু দিন আগে নাইট কোচে ঢাকার বাইরে যাচ্ছিলাম। কোচ ছেড়ে দেওয়ার পর কোচের সুপারভাইজার বাংলা গান বাজিয়ে দিলেন। গান চলছে। হঠাৎ একজন যাত্রী সুপারভাইজারকে বললেন, মিয়া এসব কী গান বাজাইতেছ? হিন্দি গান নাই? সুপারভাইজার বাংলা গান বন্ধ করে হিন্দি গান বাজিয়ে দিলো। প্রতিবাদ করেছিলাম। কাজ হয়নি। কারণ, কোচের অধিকাংশ যাত্রী চটুল হিন্দি গানের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল।

একসময় এই দেশে রেডিওর শ্রোতা ছিল অনেক। মাঝখানে রেডিওর শ্রোতা কমে যায়। পরবর্তী সময়ে রেডিও টুডে-সহ একাধিক রেডিও চ্যানেল সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ বেসরকারি রেডিও চ্যানেলে সঠিকভাবে মাতৃভাষা গুরুত্ব পাচ্ছে না। অধিকাংশ রেডিও চ্যানেলে বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে তথাকথিত একটি স্মার্ট ভাষা তৈরি করা হয়েছে। অনেকে এই ভাষার নাম দিয়েছেন 'বাংরিজ' ভাষা। রেডিওর ভাষা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কিন্তু কম হয় না। তবু এ নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং রেডিওর 'বাংরিজ' ভাষাই বেশি উৎসাহ পাচ্ছে। “হ্যালো লিসেনার আমরা এখন আপনাদের জন্য একটি সং প্লে করছি”। এই ধরনের 'বাংরিজ' ভাষা প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি রেডিও চ্যানেলে গানের অনুষ্ঠানে একজন নামকরা শিল্পী গান গাইছিলেন। উপস্থাপিকা কথা বলছিলেন 'বাংরিজ' ভাষায়। একপর্যায়ে তিনি গায়িকার প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন, ‘আপনি এত সুন্দর করে সংটা গেলেন (হবে গাইলেন) ওয়াও... অসাম। রিয়েলি ফ্যানটাসটিক। প্রশ্নটা করতেই চাই, এই ধরনের 'বাংরিজ' ভাষায় কথা বলার যুক্তি কী? ইংরেজি বলতে চাইলে পুরোটাই ইংরেজিতে হোক। তা না হলে পুরোটাই বিশুদ্ধ বাংলায় হোক। এটাই তো যুক্তির কথা নাকি?

শুধু রেডিও নয়, দেশের টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমেও বাংলা ভাষার প্রকৃত চর্চা হচ্ছে না। টিভি নাটকেও জগাখিচুড়ি ভাষা ঢুকে যাচ্ছে। প্রমিত বাংলা ভাষা উপেক্ষিত হচ্ছে গণমাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। যে অনুষ্ঠানে বাংলায় উপস্থাপনা করা যায় সেই অনুষ্ঠানও ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে উপস্থাপনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের ভাষা চর্চা নিয়ে অনেক প্রশ্ন। উরাধুরা টাইপের ভাষা চর্চায় তরুণদের আগ্রহ বেশি।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো উচ্চ শিক্ষায়ও উপেক্ষিত হচ্ছে আমাদের মাতৃভাষা। বাজারমুখী কাঠামোর কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেকটাই এখন নির্বাসনে। ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ১৮টি বাংলা পড়ানো হয়।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন বিয়ের অনুষ্ঠানের কার্ড, সেমিনার সিম্পোজিয়াম, এমনকি ভিজিটিং কার্ডও আমরা ইংরেজি ভাষায় করি। বিয়ের কার্ড বাংলা ভাষায় হলে ক্ষতি কী? অজপাড়াগাঁয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ইংরেজিতে দাওয়াতপত্র ছাপানো হয়। এর যৌক্তিকতা কি আমি বুঝি না।

প্রিয় পাঠক, ভাববেন না আমি বিদেশি ভাষার বিপক্ষে কথা বলছি। বরং আমি মনে করি প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে আরও মর্যাদাবান করে তুলতে হলে ভিন দেশের ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। যদি ইংরেজি ভাষার কথাই বলি, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইংরেজির প্রতি দক্ষতা বাড়াতেই হবে। এটা সময়ের চাহিদা। তাই বলে বাংলাকে উপেক্ষা করে নয়। ইংরেজি বাংলার মিশেলে যে 'বাংরিজ' ভাষা তৈরি হচ্ছে তা বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষার একটিকেও মর্যাদাবান করে তুলবে না। আবার 'বাংরিজ' ভাষাও কারও স্বীকৃতি পাবে না। তাহলে 'বাংরিজ' ভাষা চর্চার প্রতি কেন এই ঝোঁক?

একটি ভাষাও আদর, যত্ন, ভালোবাসা চায়। সঠিক চর্চার মাধ্যম ভাষা টিকে থাকে। মাতৃভাষা বাংলা চর্চায় আমরা কি সঠিক দায়িত্ব পালন করছি? চিঠি তো কবেই হারিয়ে গেছে। এখন মুঠোফোনে এসএমএস পাঠিয়েই আমরা মূলত তথ্য আদান প্রদান করি। বাংলায় এসএমএস করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইংরেজিতেই এসএমএস পাঠাই অনেকে। এটাও ভাষা চর্চার একটি অন্তরায়।

কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা আরও কঠিন। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা বোধকরি এমনই একটি সংকটের মাঝে দাঁড়িয়েছে। ভাষার দাবিতে একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টি হলো। অথচ সেই ভাষাই আজ উপেক্ষিত। অনেকে হয়তো বলবেন ‘উপেক্ষিত’ কথাটা ঠিক নয়। বাংলাদেশের মানুষ তো বাংলাতেই কথা বলে। কাজেই ভাষা উপেক্ষিত হলো কোথায়? এখানেই রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সত্যি কি আমরা বাংলায় কথা বলি? গ্রাম হয়তো বলে। শহর কি বাংলায় কথা বলে? দেশের প্রতিটি শহরে প্রতিষ্ঠানের নামফলক, রাস্তার সাইনবোর্ড দেখে কি মনে হয় আমরা একদিন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করেছিলাম? যে দেশে এখন পর্যন্ত মাতৃভাষাকে আদালতের ভাষা করা যায়নি সে দেশে মাতৃভাষার ভবিষ্যৎ কি সহজেই অনুমান করা যায়।

তবে এই লেখাটি হতাশা প্রকাশের জন্য নয়। আশা প্রকাশের জন্যই... আশা আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দেশে দেশে নিজ নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা নিয়েও কথা হবে। যে পথ দেখায় সেই থাকে এগিয়ে। বাংলা ভাষা পথ দেখিয়েছে। কাজেই তাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা, অনেক ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসি... অনেক ভালোবাসি...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ