X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা ও মানবাধিকার রাজনীতি

মো. জাকির হোসেন
১৩ মার্চ ২০২২, ১৬:২০আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২২, ১৬:২০

মো. জাকির হোসেন ছেলেবেলায় রুপকথার গল্পে রাক্ষস ও দৈত্য-দানবের কথা শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। বড় হয়ে বুঝলাম এসব কেবলই রুপকথা, বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে আবার দেখতে পেলাম মার্ক জাকারবার্গ উদ্ভাবিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কল্পনার রাক্ষস কিংবা দানবের চেয়েও ভয়ংকর এক জিনিস। গিলে খাচ্ছে শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা। উসকে দিচ্ছে সংঘাত, সহিংসতা ও উগ্রবাদ। সর্বগ্রাসী রুপে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভুয়া তথ্য, ঘৃণা, বিদ্বেষ, যৌনতা ও অশ্লীলতা। চরিত্রহনন, মুদ্রাপাচার, মানবপাচার, জুয়া ও সাইবার সহিংসতা সহ নানা অপরাধের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠছে এটি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা উপকারিতা ও সুবিধা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি এটিও অনস্বীকার্য যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমাজের বুননকে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই এর নিয়ন্ত্রণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোম্পানিগুলো সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, সাইবার-বুলিং সহ ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু থেকে ব্যবহারকারীদের রক্ষা করতে স্ব-শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো সাইটগুলোর নিজস্ব নিয়ম রয়েছে যা অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু দ্রুত মুছে ফেলা এবং এটি প্রথম স্থানে প্রকাশ হওয়া প্রতিরোধ করার জন্য পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। ইউটিউব ও ফেসবুক নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে অনুপযুক্ত বিষয়বস্তু অপসারণের ডাটা দেয়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর সুনামির কারণে শুধু কোম্পানির একার পক্ষে এটি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

গুগল-এর মালিকানাধীন ভিডিও-শেয়ারিং সাইটটি বলেছে ২০১৯ সনের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৮৮ লাখ ভিডিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়সীমার মধ্যে এটি ৩৩ লাখ ক্ষতিকারক চ্যানেল ও ৫১ কোটি ৭০ লাখ অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য অপসারণ করেছে।

অন্যদিকে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে এই তিন মাস সময়ে তারা ৩ কোটি ৩০ লাখ ক্ষতিকারক বিষয় সরিয়ে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রক কোম্পানিগুলোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এটি দিন দিন প্রায় বল্গাহীন হয়ে উঠছে।

২০২১ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা বলেছেন, ঘৃণা ও ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি তৈরি করছে। মারিয়া আরও অভিযোগ করেছেন, প্রতিষ্ঠানটির অ্যালগরিদম ভুয়া তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানো ঠেকানোকে অগ্রাধিকার দিতে সফল হয়নি। এমনকি তথ্য প্রকাশ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে ফেসবুক। ফেসবুকের সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন ‘ভীতিকর ও মুসলিমবিদ্বেষী’ কনটেন্ট ছড়ানো ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছেন ফেসবুকের বিরুদ্ধে।

ফেসবুক গ্রুপ কিংবা পেজে ব্যবহারকারীরা ‘ভীতিকর ও মুসলিমবিদ্বেষী’ কনটেন্ট ছড়াচ্ছে জেনেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি। হিন্দি ও বাংলা শব্দগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারার মতো অ্যালগরিদম না থাকায় ফেসবুক তেমন কনটেন্ট শনাক্ত করতে পারে না বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সেস হাউগেন। ফলে ফেসবুকের যে সংস্করণটি এখন আছে, ‘সেটি আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ছিঁড়ে ফেলছে।’

এমনি বাস্তবতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আইন তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। জার্মান সরকার ২০১৮ সালে NetzDG আইন পাস করেছে। এই আইনে বলা হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিকে তাদের সাইটে প্রকাশিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিযোগ পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেআইনি বিষয়বস্তু প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা অপসারণ করতে হবে। কোম্পানিগুলো কীভাবে কাজ করছে সে সম্পর্কে প্রতি ছয় মাস অন্তর আপডেট প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। আইন আরোপিত শর্তপালনে ব্যর্থ হলে ব্যক্তি পর্যায়ে ৫০ লাখ ইউরো ও কোম্পানির ক্ষেত্রে ৫ কোটি ইউরো জরিমানা দিতে হবে। জার্মান সরকার জুলাই ২০১৯-এ ফেসবুককে NetzDG আইনের অধীনে প্রথমবারের মতো ২০ লাখ ইউরো জরিমানা করে। ভারতে ২০২১ সনে প্রণীত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কর্তৃপক্ষকে কোনও ব্যবহারকারীর পোস্ট মুছে দেওয়া এবং ব্যবহারকারীরর নাম-পরিচয় প্রকাশের অনুরোধ করতে পারবে সরকার।

ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইনস ও ডিজিটাল মিডিয়া এথিকস কোডের আওতায় কোনও কন্টেন্টের ব্যাপারে আইনি আদেশ পাওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাকে সেই কন্টেন্ট মুছে ফেলতে হবে, এছাড়াও সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে কোন ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া ২০১৯ সালে প্রণীত আইনে ঘৃণ্য ও হিংসাত্মক বিষয়বস্তু প্রকাশের কারণে সামাজিক মিডিয়া সংস্থাগুলোর বৈশ্বিক টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত জন্য আর্থিক দণ্ড ও প্রযুক্তি নির্বাহীদের জন্য তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান করেছে। ২০১৫ সালে প্রবর্তিত Enhancing Online Safety Act এর আওতায় eSafety Commissioner পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ই-সেফটি কমিশনারের কার্যালয় সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আপত্তিকর বিষয়বস্তু অপসারণের নোটিশ প্রদান সহ ৫ লাখ ২৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার জরিমানা করতে পারে। আপত্তিকর বিষয়বস্তু পোস্ট করার জন্য ই-সেফটি কমিশনার একজন ব্যক্তিকে ১ লাখ ৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার জরিমানা করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার টিভি উপস্থাপক ও নেক্সট টপ মডেলের বিচারক শার্লট ডসন আত্মহত্যা করার পরে আইনটি চালু করা হয়েছিল। টুইটারে ডসনের বিরুদ্ধে সাইবার-বুলিং প্রচারণার পর ২০১৪ সালে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। রাশিয়ায় গত নভেম্বর মাস থেকে একটি আইন কার্যকর করা হয়েছে যেখানে দেশীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ‘জরুরি অবস্থায়’ বিশ্বব্যাপী ওয়েবে সংযোগ বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার ডাটা আইনে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলো কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ সার্ভারগুলোতে রাশিয়ানদের সম্পর্কে কোনও ডাটা সংরক্ষণ করতে পারবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত আইন মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে রাশিয়া লিঙ্কডইন বন্ধ করে দিয়েছে এবং ফেসবুক ও টুইটারকে নানা সময়ে জরিমানা করেছে।

কানাডা সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে আইন তৈরি করেছে। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেআইনি এবং ক্ষতিকর কোনও বক্তব্য প্রচারিত হলে পুলিশ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং বক্তব্য পোস্টকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে। আইনে পোস্টকারী এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় ধরনের জরিমানা এবং কঠিন শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কানাডার আইনটিতে তিনটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিশু পর্নোগ্রাফি, হেইট স্পিচ এবং বিনা সম্মতিতে কারো অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কানাডার একটি সংস্থা আইনটি প্রণয়নের আগে আইনটি সম্পর্কে নাগরিকদের মতামত জানার জন্য জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে অধিকাংশ কানাডিয়ানই চায় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমগুলো সরাসরি সরকারের তদারকির আওতায় থাকুক। টুইটার, গুগল এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো সাইটগুলি চীনে নিষিদ্ধ। এর পরিবর্তে চীন Weibo, Baidu and WeChat এর মাধ্যমে পরিষেবা প্রদান করে থাকে। চীনের Cyberspace Administration নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ ও জুয়া খেলা সহ ক্ষতিকারক নানা মোবাইল আ্যাপ আপসারণ করে থাকে। এছাড়াও চীনে কিছু কিওয়ার্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেন্সর করা হয়। সংবেদনশীল হিসাবে দেখা হয় এমন নতুন শব্দগুলি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয় বা সামাজিক প্ল্যাটফর্ম থেকে ফিল্টার আউট করা হয়।

চীনে কয়েক হাজার সাইবার-পুলিশ রয়েছে, যারা সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং সংবেদনশীল স্ক্রিন বার্তাগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে থাকে।

রাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক দিক নিয়ন্ত্রণে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনে আছে বিশেষত চরমপন্থী বিষয়বস্তু সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক ঘণ্টার মধ্যে মুছে না দিলে জরিমানা গুণতে হবে। এছাড়া ইইউ জেনারেল ডাটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) এর আওতায় সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো কীভাবে ব্যবহারকারীদের ডাটা সঞ্চয় এবং ব্যবহার করবে তার শর্তাবলী তৈরি করেছে।

অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে কিছু দেশে চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রার্থীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রফাইল, স্ট্যাটাস, শেয়ার ইত্যাদি বিবেচনা করা হচ্ছে। বেলজিয়ামের Ghent University-র Professor Stijn Baert এক জরিপে দেখিয়েছেন, ফেসবুকে যাদের প্রফাইল ছবি বিতর্কিত, তারা নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ডাক পাননি। নিয়োগকারী সংস্থা অনেক সময় চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে পাসওয়ার্ড নিয়ে ফেসবুক পরীক্ষা করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের ফেসবুক কমেন্ট, স্ট্যাটাস ইত্যাদি কোনও কলেজের নীতিমালা বা মূল্যবোধের পরিপন্থী হলে ওই কলেজে সে ভর্তির সুযোগ পাবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিলো এমন কয়েকজনকে এমনকি ক্যাম্পাসে পা রাখার আগেই তাদের ভর্তি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। কারণ অনুপযুক্ত সামাজিক মিডিয়া পোস্ট। ভার্জিনিয়ায় রিচমন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের কারণে ভর্তি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ২০১৭ সনে আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ কলেজিয়েট রেজিস্ট্রার ও অ্যাডমিশন অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত Social Media Monitoring and the Admissions Process শিরোনামের একটি সমীক্ষা অনুসারে ১১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে তারা ‘সোশ্যাল মিডিয়া বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে ভর্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন’ এবং অন্য ৭ শতাংশ একই কারণে ভর্তির অফার প্রত্যাহার করেছেন।

 বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের (ওটিটি) জন্য নতুন খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে। ওয়েবসাইটে প্রকাশ হওয়া নীতিমালায় বিটিআরসি জানিয়েছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ডিজিটাল মাধ্যম ও ওটিটি মাধ্যমের জন্য খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনাগুলোর পর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যমে শৃঙ্খলার বিষয়ে একজন আইনজীবী রিট মামলা করেছিলেন। সেই রিট মামলার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট বিটিআরসিকে নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশে বিটিআরসি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে আদালতে পেশ করেছেন। ‘দ্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন’ রেগুলেটরি কমিশন রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্লাটফর্মস’ নামের খসড়া নীতিমালাটি গত ৩ ফেব্রুয়ারি জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই নীতিমালার ওপর মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নীতিলার খসড়া অনুযায়ী, ফেসবুক এবং ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য এবং খবর প্রচার বা পোস্ট করলে তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হেয় করে মন্তব্য বা কটুক্তি করা যাবে না। কোনও ধর্মের অনুসারীদের আহত করে বা আঘাত দেয়-এমন মন্তব্য বা বিষয় প্রচার করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, এমন কিছু করা যাবে না। বিনোদনের ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে অশ্লীল এবং অনৈতিক কোনও কন্টেন্ট প্রচার করা যাবে না। বাংলাদেশে পরিচালিত প্রতিটি ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন বিনোদনমূলক প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য বিটিআরসির কাছ থেকে নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই নিবন্ধন পেতে হলে বিটিআরসি কিছু শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দেশে পরিচলিত যেকোনও ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অফিস বাংলাদেশে থাকতে হবে। সংবাদ, কিউরেটেড কন্টেন্ট, ফিল্ম এবং ওয়েব সিরিজ রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এনওসি বাধ্যতামূলক।

কোনও ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধের দায়ে দুই বছর দণ্ডিত হলে এবং কারামুক্তির পর ৫ বছর অতিবাহিত না হলে তিনি কোনও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। কোনও ব্যক্তি ঋণের দায়ে দেউলিয়া ঘোষিত হলে এবং ব্যাংক কর্তৃক খেলাপী ঘোষিত হলেও তিনিও নিবন্ধন পাওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

সোশ্যাল-ডিজিটাল-ওটিটি মাধ্যমের এই খসড়া প্রবিধিমালা প্রত্যাহার ও পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছে ৪৫ আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে এটি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তাকে বিপন্ন করবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এনক্রিপশন ও অনলাইন নিরাপত্তাকেও দুর্বল করবে এমন প্রবিধি। এটির প্রয়োগ মানবাধিকারের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অজানা নয় যে, বাক-স্বাধীনতার অধিকার চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়, বরং শর্তযুক্ত।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৬৬-এর ১৯ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাক-স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগের সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। অতএব এসব অধিকারের ওপর কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। তবে অনুরূপ বাধা-নিষেধসমূহ কেবল আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সেগুলো: (ক) অন্যের অধিকার ও সুনামের প্রতি সম্মানের জন্য; (খ) জাতীয় নিরাপত্তা অথবা জনশৃঙ্খলা অথবা জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতার জন্য যেরূপ আবশ্যক কেবল সেরূপ হবে।

অন্যদিকে, ২০ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিভেদ, শত্রুতা অথবা সহিংসতা প্ররোচিত করে এমন কোনও জাতিগত, বংশগত অথবা ধর্মগত বিদ্বেষের সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা করা আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ থাকবে।’ মানবাধিকার আইন মতো প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন দিয়েছে তেমনই অন্যের জন্য ক্ষতিকর এমন বক্তব্য, তথ্য, ভুল বা বিকৃত তথ্য প্রচারণার বিরুদ্ধে আইনি কাঠামোও বিদ্যমান আছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই সব আইনি কাঠামোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বল্গাহীন হয়ে ওঠেছে। ফলে অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরকেও একটি আইনি কাঠামোর কথা ভাবতেই হয়েছে।

ইসলাম ধর্মে স্রষ্টার পরে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হচ্ছেন রাসুল (সা.)। নিজের জীবনের চেয়েও রাসুল (সা.)কে ভালোবাসা ইবাদতের অংশ। সেই প্রিয় রাসুল (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র যখন প্রকাশ করা হলো, সমগ্র মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো। অথচ এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসাবে দাবি করা হলো। কোটি কোটি মুসলমানের অধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে এই ৪৫ সংস্থাকে কোনও বিবৃতি দিতে দেখিনি। হিজাব পরিধান করা কুরআনের অত্যাবশ্যক নির্দেশ। দেশে দেশে যখন হিজাব নিষিদ্ধ করা হলো। এই সংস্থাগুলোকে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের (ওটিটি) জন্য প্রণীত নতুন খসড়া নীতিমালার ওপর ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে মতামত প্রদানের সুযোগ গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু তা না করে সোশ্যাল-ডিজিটাল-ওটিটি মাধ্যমের এই খসড়া প্রবিধিমালা প্রত্যাহার ও পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে সরকারকে চিঠি প্রদান স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তার মানে আপত্তি উত্থাপনকারী সংস্থাগুলো মানবাধিকার রক্ষা নয়, মানবাধিকারের নামে রাজনীতিতে কখনও সরব আর কখনও নীরব।

লেখক:  অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ