X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইউক্রেনের নিরপেক্ষ না থাকার ‘অপরাধ’

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৩ মার্চ ২০২২, ২০:২০আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২২, ২০:২০

ডা. জাহেদ উর রহমান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিয়ারশাইমার একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রে তিনি ‘রিয়াললিস্ট স্কুল অব থট’ অর্থাৎ পরিস্থিতি বাস্তববাদীভাবে বিশ্লেষণের পক্ষপাতী তিনি। তার এই পয়েন্টের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত।

এই দফার ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর এবং যুদ্ধ শুরুর পর সামাজিক মাধ্যমে দেখছি ভীষণ তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। আমার খুবই ভালো লেগেছে এটা দেখে এ ধরনের অতি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয়ে আমরা আমাদের মতো করে বিতর্ক করছি। আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি দেখা যায়, সেটা হচ্ছে সবাই নীতি-নৈতিকতার ওপরে ভিত্তি করে আলোচনার চেষ্টা করছেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ভূ-রাজনীতির আলোচনায় নীতি-নৈতিকতাকে একেবারে বাদ দিতে হবে এমনটা বলছি না। চলুক সেই আলোচনা, কিন্তু ইউক্রেন সংকটের মতো বিষয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এটা খুবই ইউটোপিয়ান চিন্তা। আমাদের বরং অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বাস্তবে যা আছে, বাস্তবে যা ঘটে সেটাকে। এখানেই মিয়ারশাইমারের সাথে একমত আমি। আমি বিশ্বাস করি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেমন হবে, কোনও দেশ অপর কোনও দেশের সাথে কেমন আচরণ করবে, সেটা প্রায় পুরোপুরি নির্ভর করে দুটো দেশের জনগণ, নিদেনপক্ষে দেশগুলোর ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের ভিত্তিতে।

ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর অধ্যাপক মিয়ারশাইমারের একটা লেকচার আমাদের সচেতন মানুষদের মধ্যে খুব আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ‘ইউক্রেন পরিস্থিতি যে কারণে পশ্চিমাদের দোষে ঘটছে’ (হোয়াই ইজ ইউক্রেন দ্য ওয়েস্ট’স ফল্ট) শিরোনামের এই লেকচারের মূল বিষয় হচ্ছে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করার চেষ্টাটাই যাবতীয় সংকটের মূল।

পুতিন বার বার স্পষ্টভাবেই বলেছেন, তিনি ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। এর জন্য তিনি যে কোনও কিছু করতে প্রস্তুত। সেটা যে শুধু কথার কথা না, সেটা প্রমাণ তিনি দিয়েছিলেন জর্জিয়া ন্যাটোর সদস্য হওয়ার চেষ্টা করার পর জর্জিয়াকে আক্রমণ করে। আক্রমণ করেই থেমে থাকেননি তিনি, জর্জিয়ার অংশ দক্ষিণ ওসেটিয়া আর আবখাজিয়া কার্যত দখল করে নিয়েছেন। এখন একই সংকট হচ্ছে ইউক্রেনকে নিয়ে।

ছয় বছর আগের লেকচারটিতে মিয়ারশাইমার বলছেন– ইউক্রেনকে ন্যাটোতে নেবার পশ্চিমা পরিকল্পনাই ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেনের পূর্বের ডনবাস অঞ্চলে যুদ্ধের কারণ। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই দেশের অনেক মানুষ বলছেন, ইউক্রেনের ওপরে সর্বাত্মক যুদ্ধের পেছনেও কারণ এটাই। মিয়ারশাইমার বলছেন, আর সেটারই প্রতিধ্বনি করছেন আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষ– ইউক্রেন কোনোভাবেই ন্যাটো সদস্য হতে পারবে না, পুতিনের চাওয়া এই গ্যারান্টি পশ্চিমাদেরকে দিতে হবে।

ইউক্রেন শুধু ন্যাটো নয়, এর আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিতে গিয়েও রাশিয়ার প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখে পড়েছিল। ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য হলে সেই দেশের জনগণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত হলে কেন সেটা করবে না, একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ কোন জোটে যাবে সেটার সিদ্ধান্ত কেন নিজ ইচ্ছায় নিতে পারবে না, পুতিনের অলিখিতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনিরুজ্জীবিত করার খায়েশ থেকে বাঁচতে কেন সে ব্যবস্থা নেবে না, একটা অতি পরাক্রমশালী দেশের তথাকথিত নিরাপত্তা হুমকির কারণে একটা স্বৈরাচারী শাসক নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীতন্ত্রের অধীনে বাস করবে এসব যৌক্তিক প্রশ্ন সরিয়ে রাখি আপাতত। আলোচনার খাতিরে ধরে নিলাম, মিয়ারশাইমারের কথা মতো ইউক্রেন রাশিয়া আর ন্যাটোর মাঝে একটি নিরপেক্ষ ‘বাফার স্টেট’ হয়ে থাকলেই ভালো হবে।

এই পৃথিবীর মোটামুটি নিয়ম হচ্ছে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করবে। অতি প্রাচীন কাল থেকেই একটি শক্তিশালী রাজ্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজ্যকে সরাসরি দখল করে নিত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘের কাঠামোর মধ্যে আমরা যে ধরনের বিশ্ব ব্যবস্থা মেনে নিয়েছি তাতে এখন কোনও দেশ পুরোপুরি দখল করে ফেলার প্রবণতা নেই বললেই চলে। তবে এই ব্যবস্থায় শক্তিশালী দেশগুলো চেয়েছে অন্য দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব বজায় রাখতে। রাশিয়া নিজেও এই চর্চার বাইরে নয়।

রাশিয়ার একটি অর্থনৈতিক জোট আছে, যার নাম ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ)। রাশিয়া ছাড়া বাকি সদস্যদেশগুলো হচ্ছে আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান। রাশিয়ার একটি সামরিক জোটও আছে যার নাম কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)।  অর্থনৈতিক জোটের সব দেশ সামরিক জোটেরও সদস্য। একটি দেশ, তাজিকিস্তান অর্থনৈতিক জোটের সদস্য না হলেও সামরিক জোটের সদস্য।

একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল সফল হওয়ার জন্য সেই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা অন্তত ২৫ কোটি হওয়া উচিত, এমন একটি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব আছে নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানের। সেই বিবেচনায় রাশিয়ার নেতৃত্বের অর্থনৈতিক জোটটি সফল হতে হলে (যার মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি) চার কোটির বেশি জনসংখ্যার ইউক্রেন খুবই মূল্যবান।

পুতিনের দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য, ইউক্রেন রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) সদস্য হবে। রাশিয়া চায়, ইউক্রেন তার নেতৃত্বাধীন মুক্ত বাণিজ্য জোট ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নেরও (ইএইইউ) সদস্য হোক। তাই ইউক্রেনের পক্ষে কি নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব ছিল? ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকার নিশ্চয়তা ছিল কি রাশিয়ার দিক থেকে?

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার পর ইউক্রেনে সবচেয়ে বেশি (৩ হাজারের মতো) পারমাণবিক বোমা ছিল। সেগুলো যদি তার কাছে থাকতো তাহলে আমেরিকা এবং রাশিয়ার পরে ইউক্রেন হতো তৃতীয় সর্বোচ্চ পারমাণবিক বোমার অধিকারী দেশ। ১৯৯৪ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে (বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম) ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত হয়ে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

ইউক্রেনের সঙ্গে সেই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া ইউক্রেনের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং তৎকালীন সীমান্তের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি দিয়েছিল। দেশগুলো এই গ্যারান্টিও দিয়েছিল যে তারা কখনও ইউক্রেন কর্তৃক আক্রান্ত না হলে ইউক্রেনকে হামলা করবে না। ইউক্রেন অন্য কোনও দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই দেশগুলো তাকে রক্ষা করবে। এছাড়াও দেশগুলো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবেও কোনও ক্ষতিকর পদক্ষেপ নেবে না।

এখানে জরুরি তথ্য হচ্ছে ওই চুক্তিতে কোথাও উল্লেখ করা ছিল না যে ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা ন্যাটো সদস্য হতে পারবে না। সুতরাং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কিংবা ন্যাটোর সদস্য হতে চেয়ে চুক্তির বরখেলাপ করেনি। বরং রাশিয়া এমন শর্তের ধুয়ো তুলে ইউক্রেনকে আক্রমণ করে চুক্তি ভঙ্গ করেছে।

এগুলো খুব অভাবনীয় ঘটনা না, খুব শক্ত চুক্তি থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোনও পক্ষ, বিশেষ করে অতি শক্তিমানরা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে। এটাই রাশিয়াকে শতভাগ অবিশ্বাস করার জন্য ইউক্রেনের কাছে যথেষ্ট কারণ হবার কথা ছিল, কিন্তু ঘটেছে আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা।

বেশ কিছুদিন আগে ভ্লাদিমির পুতিন একটি দীর্ঘ রচনা লিখে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন ইউক্রেন বাস্তবে কোনও দেশ নয়; সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় কৃত্রিমভাবে এটিকে দেশ বানানো হয়েছে। তার এই রচনাটি ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। এমনকি ইউক্রেনের ওপরে সর্বাত্মক আক্রমণ করার আগে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক বাচনভঙ্গি এবং দেহভঙ্গিতে যে ভাষণ পুতিন দিয়েছিলেন সেখানেও বারবার জোর দিয়ে বলেছেন ইউক্রেনের স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার যোগ্যতা না থাকার কথা। যে মানুষটা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন না সেই মানুষের ইউক্রেনের নিরপেক্ষ থাকার আশ্বাস কীভাবে সে দেশের জনগণ বিশ্বাস করবে?

মিয়ারশাইমার ইউক্রেনকে যে বাস্তববাদী পরামর্শ দিয়েছিলেন নিরপেক্ষ থাকার, সেটা যথেষ্ট বাস্তববাদী নয়, ইউক্রেনকে কোনও একটা পক্ষে যেতেই হবে এটাই বরং দেশটির বাস্তবতা। ইউক্রেন চেয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ৩ বাল্টিক দেশ লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়ার মতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সাথে গিয়ে গণতান্ত্রিক পথে জনগণের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে।

ইউক্রেন চায়নি রাশিয়ার জোটের দেশগুলোর মতো জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অধীনে থাকতে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পোশাকশ্রমিককে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
পোশাকশ্রমিককে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
ইউক্রেনের অন্তত ৭টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম প্রয়োজন: ন্যাটোকে জেলেনস্কি
ইউক্রেনের অন্তত ৭টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম প্রয়োজন: ন্যাটোকে জেলেনস্কি
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ