X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু চিরকালের, অনন্ত অনুপ্রেরণা

প্রভাষ আমিন
১৭ মার্চ ২০২২, ১৪:১৭আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২২, ১৪:১৭

‘একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাইতে হইতেছে, অপরদিকে আমরা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হইতেছি। আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে, তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিতে আমরা সামগ্রিক ধ্বংসের ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব—যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে।

আমরা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন যে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট শুধুমাত্র শান্তি এবং আন্তর্জাতিক সমঝোতার পরিবেশেই সমাধান করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জরুরি ব্যবস্থা নিতে হইবে। ইহাতে শুধুমাত্র এই ধরনের পরিবেশই সৃষ্টি হইবে না, ইহাতে অস্ত্রসজ্জার জন্য যে বিপুল সম্পদ অপচয় হইতেছে, তাহাও মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করা যাইবে।’

এটি আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দেওয়া ভাষণ। সেই রাষ্ট্রপ্রধানের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব মানচিত্রে নবীন একটি রাষ্ট্রের প্রধান প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। স্বাভাবিক বিবেচনা কী বলে, বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে ভাষণ দেবেন, বিশ্বের কাছে নিজের দুর্দশার কথা তুলে ধরবেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য সবার সহানুভূতি চাইবেন, সাহায্য-সহযোগিতা চাইবেন। কিন্তু প্রথম ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিলেন তিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন। তিনি বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের নেতা, তিনি শুধু নির্দিষ্ট সময় বা কালের নয়; তিনি সর্বকালের। আজ যখন বিশ্ব যুদ্ধ কবলিত, তখনও ৪৮ বছর আগে দেওয়া একজন নেতার ভাষণ কী ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। কতটা দূরদর্শিতা থাকলে একজন নেতা জাতিসংঘে তাঁর প্রথম ভাষণেই গোটা বিশ্বকেই এমন মানবিক দিক নির্দেশনা দিতে পারেন!

বাংলাদেশ আজ এক সমীহ জাগানিয়া শক্তি। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের এক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬০০ ডলার, গড়ে যা ভারতের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। সম্প্রসারিত টিকা দান কর্মসূচি, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষাজাগানিয়া।

নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি প্রতীক মাত্র। সারাদেশেই অবকাঠামো খাতে অভাবিত উন্নয়ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতিতে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু একাত্তরে বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র, যার চারিদিকে শত্রু। ভারত আর রাশিয়া ছাড়া বাংলাদেশের তেমন পরীক্ষিত বন্ধু নেই। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হয়েছে বলে ইসলামি বিশ্ব বাংলাদেশকে বাঁকা চোখে দেখে। চীন তো মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আর বাংলাদেশের জন্মটাই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বড় কূটনৈতিক পরাজয়। যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেই ক্ষান্ত হননি, নিজের ভবিষ্যদ্বানী সত্য করতে চলছিল তার নানা কূটচাল। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন আত্মমর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর সোনার বাংলা গড়ার জন্য সময় পাননি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার দিকে।

আজকের মতো অনেক কিছু না থাকলেও তখন বাংলাদেশের একজন বন্ধু ছিলেন, বঙ্গবন্ধু। তার বুক ভরা ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বের মানবতার জন্য দরদ আর ছিল অপরিসীম সাহস। আমরা বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম, এটা আমাদের এবং বিশ্বের গৌরব।

বঙ্গবন্ধুর অভাব শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ তাদের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুকে অনুভব করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পায়। নরেন্দ্র মোদি যখন কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে একে একটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে পরিণত করেন, তখনও অনেককে আফসোস করতে শুনেছি, আহা কাশ্মিরের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। কাশ্মিরের একজন বঙ্গবন্ধু থাকলে কী হতো বা আদৌ কাশ্মিরের একজন বঙ্গবন্ধু থাকা সম্ভব ছিল কিনা জানি না। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা আসলে ক্ষণজন্মা। বাংলাদেশ ভাগ্যবান, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা পেয়েছে। কাশ্মির কেন, বিশ্বের যে কোনও দেশের জন্যই বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া কঠিন।

বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের নন, শুধু বাংলাদেশের নন; তিনি সারাবিশ্বের। যেখানেই নিপীড়ন নির্যাতন, সেখানেই অনুপ্রেরণার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভারতের আধিপত্যের প্রসঙ্গে কাশ্মিরের আগে আগে সিকিম প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশের পরিণতিও তেমন হতে পারতো। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল। ২ কোটি শরণার্থী ভারতের মাটিতে ছিল নয় মাস। প্রবাসী সরকার পরিচালিত হয়েছে কলকাতা থেকে। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন ভারতের মাটিতে থেকে, তাদের প্রশিক্ষণে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারত সরাসরি যুদ্ধে নামে। ভারত নিশ্চয়ই এতটা উদার নয় যে কোনও স্বার্থ ছাড়াই বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে সাহায্য করবে। তাদের প্রথম স্বার্থ ছিল, তাদের চির বৈরী পাকিস্তানকে দুই ভাগ করে দেওয়া। আর স্বাধীন বাংলাদেশে আস্তানা গেঁড়ে বসার গোপন আকাঙ্ক্ষাও হয়তো ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি বঙ্গবন্ধুর কারণে। ৭২’র ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্য ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দেশে ফেরার পথে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু জানতে চান, ভারতের সেনারা কবে নাগাদ বাংলাদেশ ছাড়বে। কিছুটা চমকে গেলেও ইন্দিরা গান্ধী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই ভারতের সেনা প্রত্যাহারের অঙ্গীকার করেছিলেন এবং তিনি কথা রেখেছিলেন। ৭২’র ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেই ভারতের শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি ত্যাগ করেছিল। যারা ভেবেছিলেন পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ ভারতের খপ্পড়ে পড়বে; তাদের ভুল প্রমাণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি আমাদের বিজয় দিবস। কিন্তু ৭২’র ১৭ মার্চ দিনটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় এসেছে, আর ১৭ মার্চ তা সংহত হয়েছে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে এভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের উদাহরণ গোটা বিশ্বেই বিরল। সত্যিই বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বঙ্গবন্ধু সব কালের, সব মানুষের, সব দেশের নিপীড়িত মানুষের নেতা, অনন্ত অনুপ্রেরণা।

লেখাটি শুরু করেছিলাম জাতিসংঘে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ দিয়ে। আজ ১০২তম জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষটাও করতে চাই সেই ভাষণ থেকেই। তিনি সেদিন আলজেরিয়া, গিনি বিসাউ, ভিয়েতনাম, ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে ঘোষণা করেছিলেন, ‘চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে’।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/আইএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত আমরা নিজেরাই নেব: নেতানিয়াহু
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ঝালকাঠিতে নিহত ১৪ জনের পরিবার পাচ্ছে ৫ লাখ টাকা করে
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ