X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

টিসিবির পণ্য আর কিছু ধনীর জন্ম

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৭ মার্চ ২০২২, ২০:৫০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২২, ২০:৫০

ডা. জাহেদ উর রহমান যাদের কিছুটা আগ্রহ আছে দেশের অবস্থা বোঝার, যাদের কিছুটা চোখ-কান খোলা রাখার অভ্যাস আছে, তারা এই ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় টিসিবির ট্রাকের লাইনের দৈর্ঘ্য দ্রুত বাড়তে দেখেছেন কয়েক মাস ধরেই। দেখেছেন, ট্রাক আসার আগে থেকেই অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন পণ্য পাবেন বলে। আর আজকের সামাজিক মাধ্যমের যুগে প্রত্যেকেই এখন নাগরিক সাংবাদিক, তাই ট্রাকের পেছনে মানুষের উদভ্রান্তের মতো দৌড় দেওয়া, লাইনে মানুষের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া—এসব আমরা দেখছি প্রতিনিয়ত।

ট্রাকের পেছনে লাইনে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো দীর্ঘদিন থেকে মধ্যবিত্তদেরও দেখতে পাচ্ছিল। নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তারা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কেমন হাঁসফাঁস করছেন, তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। অবশ্য মধ্যবিত্তের টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো এখন এতটাই বেড়ে গেছে যে শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যমন্ত্রীও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ভালো জামাকাপড় পরা’ মানুষকেও টিসিবির ট্রাকের লাইনে দেখা যাচ্ছে।

টিসিবির লাইন নিয়ে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে পড়ছিল। লাইনের পেছনে দাঁড়ানো মানুষরা পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া এমনকি মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছিলেন। মাঠে অভাবী মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়া যেকোনও ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য নিশ্চয়ই এক অশনি সংকেত। বোধ করি এই ভীতি থেকেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এক কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য দেবে। এরমধ্যেই এক দফা পণ্য দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হবে আরেক দফা।

করোনার পরে এই দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া মানুষের সংখ্যা গত বছরের শেষেই পৌঁছেছিল সাড়ে সাত থেকে আট কোটিতে। ব্র্যাক-পিপিআরসি এবং সানেমের মতো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিল এমন তথ্য। এর সঙ্গে গত কয়েক মাসে যুক্ত হয়েছে অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধিজনিত অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আরও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নেমে যাবার কথা– অর্থনীতির খুবই বেসিক ধারণা থাকা মানুষ এটা জানেন। সেই তুলনায় এক কোটি পরিবারের সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি মানুষকে এই পণ্য দেওয়ার মানে হলো আরও অসংখ্য দরিদ্র মানুষকে আওতার বাইরে রাখা।

এই হিসাবটা হচ্ছে যদি এক কোটি মানুষের তালিকা মোটাদাগে নিখুঁত হয়। কিন্তু সরকারের নিজের হিসাবই বলছে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত মানুষদের ৪৬ শতাংশই সেই সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য নন অর্থাৎ তারা সামর্থ্যবান মানুষ। এরা মূলত এই তালিকা করা জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতজন। এই তথ্য মাথায় রাখলে দরিদ্র মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছার পরিমাণ অর্ধেকে পরিণত হবে।

প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি পদক্ষেপ কত অপর্যাপ্ত তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে দেশের মিডিয়াগুলোর দিকে চোখ রাখলেই। প্রথম দফার পণ্য দেওয়ার সময় বহু মানুষ ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন যাদের কাছে কার্ড ছিল না। এমনকি কার্ড পাওয়া বহু মানুষও পণ্য পায়নি। আর পণ্য পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর দুর্ভোগ তো ছিলই। এছাড়াও আছে সব পণ্য নেওয়ার বাধ্যবাধকতা। প্রয়োজন না থাকলেও মানুষকে পেঁয়াজ নিতে হচ্ছে। টিসিবির পেঁয়াজের দাম বাজারের সমান। শুধু সেটাও না, টিসিবি থেকে কেনা ৫ কেজি পেঁয়াজের মধ্যে এক থেকে দেড় কেজি পচা পেঁয়াজ পাবার অভিযোগ করেছেন অনেকে।

এবার কার্ডের পণ্যের কিছু হিসাব দেখে নেওয়া যাক। এই কার্ড দিয়ে একটি পরিবার দুই দফা ১১০ টাকা দরে দুই লিটার সয়াবিন তেল, ৫৫ টাকা দরে দুই কেজি চিনি, ৬৫ টাকা দরে দুই কেজি মসুর ডাল ও ৩০ টাকা কেজি দরে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারবে। প্রথম ধাপের কার্যক্রম চলবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। আগামী ৩ এপ্রিল শুরু হবে দ্বিতীয় ধাপের বিক্রি কার্যক্রম। তখন যুক্ত হবে ৫০ টাকা দরে দুই কেজি করে ছোলা।

বাজারে এই মুহূর্তে সয়াবিন তেল ১৬৫, চিনি ৮০, মসুর ডাল ১০০, পেঁয়াজ ৩০, ছোলা ৭০ টাকা। অর্থাৎ বাজার থেকে পণ্য না কিনে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে প্রথম দফায় একজন ক্রেতার  সাশ্রয় হবে ২৩০ টাকা আর দ্বিতীয় দফায় হবে ২৭০ টাকা। দুই দফায় মানুষ মোট সাশ্রয় করতে পারবে ৫০০ টাকা।

দেড় মাসে দুই দফায় প্রাপ্ত এই পরিমাণ পণ্য দিয়ে মানুষ সংসার কতটুকু চালাতে পারবেন জানি না। তবে মাথাপিছু বরাদ্দের একটা হিসাব তো করতেই পারি আমরা। পরিবারপ্রতি সদস্য সংখ্যা গড়ে ৫ জন হলে সরকার মাথাপিছু ভর্তুকি দিচ্ছে ১০০ টাকা। আর সরকারের দিক থেকে বিরাট বলে দাবি করা এই কার্যক্রমে জনগণের জন্য সরকারের ভর্তুকি হচ্ছে সাকুল্যে ৫০০ কোটি টাকা।

আর এসব পণ্য যদি পুরোপুরি বিনামূল্যেই মানুষকে দিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে প্রথম দফায় প্রয়োজন হতো ৮৪০ কোটি আর দ্বিতীয় দফায় ৯৮০ কোটি টাকা। মোট ১৮২০ কোটি টাকা। অনেক বেশি টাকা এটা?

কিছু মেগা প্রকল্প দেখিয়ে হরহামেশা দেশকে উন্নত, ধনী দেশ দাবি করা সরকার দরিদ্র মানুষদের জন্য কিছু করার ক্ষেত্রে সেই সরকারটির অনেকেই বলেন সরকার নাকি তার ‘সীমিত সামর্থ্যের’ মধ্যে যতটা সম্ভব করছে। দুই ক্ষেত্রে সরকারের দুই চেহারা।

প্রশ্ন হচ্ছে জনগণকে তার সংকটে সহযোগিতা করার জন্য ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেওয়াই কি সমাধান? আমি বিশ্বাস করি এই পণ্যে ভর্তুকি দেওয়া কোনোভাবেই সঠিক পদক্ষেপ না।

এক কোটি পরিবারকে পণ্য দেওয়ার জন্য অনেক ভোগ্যপণ্য  কিনতে হয়েছে সরকারকে। বর্তমান সরকারের কেনাকাটা নিয়ে আমরা জানি। সেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশ কেনা আর সেটা উপরে উঠানোর খরচ দিয়ে আমাদের সামনে সরকারের কেনাকাটার চেহারা উন্মোচিত হবার পর থেকে একের পর এক ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে। আমরা দেখেছি, বাজার মূল্যের চাইতে কয়েকগুণ বেশি মূল্যে নানা পণ্য কেনা হয় সরকারি প্রকল্পগুলোতে।

আমরা তো জানি না, টিসিবির ট্রাকে বিক্রির জন্য তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, ছোলা কত টাকায় সরকার কিনছে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে সরকারের আগের ইতিহাস মাথায় রাখলে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, টিসিবির ট্রাক থেকে দেওয়া পণ্য সরকার কিনবে বাজার মূল্যের চাইতে অনেক বেশি দামে।

অনেক বেশি মূল্যে পণ্য কেনা জনগণের করের টাকা এই পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পণ্যের সরবরাহকারী হিসেবে সরকারি দলের কিছু নেতা এবং দলের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যবসায়ীকে বিরাট অংকের টাকার সংস্থান করে দেবে।

অথচ সরকার চাইলে পণ্য না দিয়ে পণ্যের মাধ্যমে যত টাকা ভর্তুকি দিতে চায় সেই টাকাটা এক কোটি মানুষের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্যাশ হিসেবে দেওয়া যেত। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যুগে এটা এখন করা যায় অতি সহজে, মুহূর্তেই। সেই টাকা পেলে মানুষ তার কাছের দোকান থেকে বাজার দরে পণ্য কিনলেও ভর্তুকিটা পেয়ে যেত। এতে পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়ানোজনিত সময় নষ্ট কিংবা কষ্ট থেকে মুক্তি পেতো মানুষ।

যে কার্ডের ভিত্তিতে এবার পণ্য দেওয়া হলো সেটা এই দুইবারেই শেষ হচ্ছে না। সরকার বলেছে প্রয়োজনে একই কার্ডের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে আবার পণ্য দেওয়া হতে পারে। অর্থাৎ আবারও পণ্য কেনা এবং সেটা থেকে টাকা বানানোর বিরাট হাতছানি। এভাবে কয়েকবার করলেই দেশের ধনীর তালিকাটা সমৃদ্ধ হয়ে যাবে আরেকটু।

লেখক: অ্যাকটিভিস্ট ও শিক্ষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বঙ্গোপসাগরে ডুবলো জাহাজ, ভাসছেন ১২ নাবিক
বঙ্গোপসাগরে ডুবলো জাহাজ, ভাসছেন ১২ নাবিক
মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ ইসির
মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ ইসির
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৬
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৬
কুষ্টিয়ার তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
কুষ্টিয়ার তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ