X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: অভাব নাকি আমাদের স্বভাবই দায়ী?

কাবিল সাদি
০২ মে ২০২২, ১৮:৫৫আপডেট : ০২ মে ২০২২, ১৮:৫৬
কাবিল সাদি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভেতর চলছে হাহাকার। প্রয়োজনীয় প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। টিসিবির লাইনে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের সঙ্গে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষকেও দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও রমজান মাস এলেই এই দ্রব্যমূল্যের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি অথচ দেশের পরিসংখ্যানে দারিদ্র্যের হার বা সংখ্যা দুটোই হ্রাস পেয়েছে এবং দেশও আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃতি নিয়েই এগিয়েছে।

একটা সময় খাদ্য সংকট ছিল ভয়ানক আকারে; মানুষ মারা যেতো লাখে লাখে। উপমহাদেশে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ও স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল শতাব্দীর স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষগুলোর অন্যতম। এত দুর্ভিক্ষের বড় কারণ ছিল অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, বহিঃশক্তির আক্রমণে যুদ্ধাবস্থা বা গৃহযুদ্ধের কারণেও এই দুর্ভিক্ষ লক্ষণীয় এবং খাদ্য সংকট বা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে এই মুহূর্তে এগুলোর কোনোটাই হচ্ছে না, এমনকি নিকট অতীতেও হয়নি, অথচ না খেয়ে দলে দলে মানুষ মারাও যাচ্ছে না। বর্তমান সময়ে নিম্নবিত্ত মানুষের অবস্থা খুবই ভয়াবহ যা টিসিবির লাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদে কিছুটা ধারণা করা যায়। তাহলে আমাদের রেকর্ড সংখ্যক রিজার্ভ বৃদ্ধি, মাথাপিছু জিডিপির ভূমিকা কী বা দেশেই দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি কেন?

ভারতের প্রখ্যাত বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার  পেয়েছিলেন ঠিক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার গবেষণাকে কেন্দ্র করে। এই উপমহাদেশের বিভিন্ন সময়ের দুর্ভিক্ষ ও বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের ওপর তার করা ‘Poverty and Famines : An Essay on Entitlements and Deprivation’ গবেষণায় তিনি এক অমোঘ সত্য তুলে ধরতে সমর্থ হন।

তিনিই প্রথম জানালেন যে উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকা সত্ত্বেও একটা দেশে মানুষ না খেয়ে মারা যেতে পারে; প্রাধিকার পাওয়া উচিত ক্রয়ক্ষমতা/প্রবেশগম্যতা, লভ্যতা নয়। যুগান্তকারী এ নীতি-পরামর্শ গ্রহণ করেছে অনেক দেশ। তার গবেষণার ওঠে আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পরেও এ দেশে খাদ্য সংকট ততটা ছিল না অর্থাৎ বাজারে পণ্যের সরবরাহ ছিল, কিন্তু সেই পণ্য পাওয়ার অধিকার তথা ক্রয় ক্ষমতা মানুষের ছিল না। আর তাই বাজারে বা গুদামে খাদ্যশস্য থাকা সত্ত্বেও মানুষ  না খেয়ে মারা গেছেন। তিনি দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করেছেন। আমরা যদি তার এই গবেষণার সঙ্গে তুলনা করি, সেই অর্থে এখনও বাজারে খাদ্য সরবরাহ যথেষ্ট এবং নিকট অতীতে তো দূরে থাক গত দুই দশকে সেভাবে বড় কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশ আক্রান্ত হয়নি।

গত একযুগে যুদ্ধ তো দূরে থাক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও বিদ্যমান অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে এবং সেই সঙ্গে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অভাবী মানুষের হাহাকার। স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রীও বাজারের মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ে যে দুঃখ করেছেন মূলত এটাই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী এবং সেই সঙ্গে নির্দয় ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। উত্তরবঙ্গের একজন কৃষক মাত্র ২-৫ টাকা কেজি যে আলু বিক্রি করেন আর সেই আলু ঢাকা বা অন্যান্য জেলা শহরে আসতেই একলাফে হয়ে যায় ২০-২৫ টাকা, ১০ টাকা কেজির বেগুন হয়ে যায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে একশত টাকাও পার হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা দায় চাপান রাস্তায় নানা অজুহাতে টোল ও চাঁদাবাজির ওপর। আবার রমজান মাস এলেই এ দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী নিজ উদ্যোগে দাম বাড়িয়ে দেন, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে মজুতদার অসাধু ব্যবসায়ীরাও পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বাড়ান, যা আমরা পেঁয়াজের দামবৃদ্ধির সময় লক্ষ করেছি। আবার একশ্রেণির নাগরিক কোনও সংকটের আভাস বা গুজবের কান দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে মজুত করায় বাজারে সংকট তৈরি করেন; এটাও লবণের সংকট নিয়ে গুজব উঠানোর সময় লক্ষ করেছি আমরা। অবশ্য সরকারের কঠোর অবস্থানে সেই যাত্রায় ওই শ্রেণি সফল হতে পারেনি। একইভাবে করোনাকালীন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় চাহিদার সুযোগ নিয়ে থাকে এই অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরকারের কিছু পলিসি ছাড়া প্রায় সব জায়গায় বাজারের পণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ মূলত পণ্যের অভাব নয়, বরং আমাদের বিভিন্ন শ্রেণির স্বভাবকেই দায়ী করা চলে।

তাই সরকারকে কঠোরভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, রাস্তায় অবৈধ টোল ও চাঁদাবাজি বন্ধে আইনগত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, ভোক্তা অধিকারের কার্যক্রম বৃদ্ধিসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। একইভাবে আন্তর্জাতিক অবস্থা বিবেচনায় ভোজ্যতেল ও জ্বালানি তেলের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না একটি বিষয় আরেকটি বিষয়কে প্রভাবিত করে আর এজন্যই জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে যাতায়াত ভাড়া বৃদ্ধিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের খরচ বেড়ে যায়, কৃষকের সেচের খরচ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই সেই অতিরিক্ত খরচ তাদের উৎপাদিত শস্যের ওপর পড়বেই। ডালের ব্যবসায়ীকেও কিন্তু উচ্চমূল্যে চাল, সবজি বা অন্যান্য দ্রব্য কিনতে হয়, তাই সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও নিজেদের প্রয়োজনেই সৎ ও সচেতন হতে হবে। সার্বিকভাবে বলা যায়, আমাদের স্বভাবের পরিবর্তন ঘটালে পণ্যদ্রব্যের এই ঊর্ধ্বগতি থাকবে না, অভাবও কমে আসবে এবং নাগালের মধ্যে আসবে দ্রব্যমূল্য, টিসিবির লাইন হবে সীমিত, হ্রাস পাবে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের হাহাকার।

লেখক: নাট্যকার ও ব্যাংক কর্মকর্তা
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
প্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ