X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিরোধী জোটের জাতীয় সরকারের দাবি কতটা বাস্তবসম্মত?

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
০৫ মে ২০২২, ১৮:২৭আপডেট : ০৫ মে ২০২২, ১৮:২৭

ড. প্রণব কুমার পান্ডে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী জোটের জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতারা বর্তমান সরকারকে ‘অবৈধ সরকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এই সরকারের উৎখাতের মাধ্যমে দেশে জাতীয় সরকার গঠন করে শাসন ব্যবস্থা এবং সংবিধান পরিবর্তন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং গণমাধ্যমে।  এই দাবিটিকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে বিরোধী দল বিএনপি এবং শরিক দলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বক্তব্য দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিরোধী জোটের এই প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত? 

বিএনপি এবং শরিক দলগুলো ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে রাজনৈতিক ভুল করেছিল তার খেসারত এখনও পর্যন্ত দিতে হচ্ছে দলটিকে। সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে প্রায় এক বছর হরতাল পালনের মাধ্যমে বিএনপি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। একইসঙ্গে দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছরের ওপরে ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে এই দলের সমর্থকরা দলের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। এমনকি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আস্থাহীনতা রয়েছে এবং নেতৃত্ব বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। এমন অবস্থায় ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষে না যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, দলটির সাংগঠনিক শক্তি অনেক কমে গেছে। ফলে ২০২৩ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতায় যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হবে– এই বিষয়টি অনুধাবন করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ধরনের বিকল্প চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবনা এই ধরনের একটি বিকল্পের অংশ।

কিছুদিন আগে বিএনপি মহাসচিব ঘোষণা করেছিলেন যে ঈদের পরে সরকার পতনের সর্বাত্মক আন্দোলন করবে দলটি। এই ঘোষণার পরে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন বর্তমান সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা এ দলটির রয়েছে কিনা? 

আমাদের একটি জিনিস বুঝতে হবে যে মিডিয়ার সামনে রাজনীতি করা এবং মাঠের রাজনীতি করার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। বিএনপির রাজনীতি এখন মিডিয়া কেন্দ্রিক। মাঠের রাজনীতির সঙ্গে তাদের খুব বেশি যোগাযোগ নেই। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে জনগণকে মাঠে নামাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এইরকম একটি বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাবনা দলটি করছে তা সত্যিই একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতৃবৃন্দ জাতীয় সরকার গঠনের কথা বললেও তাদের সেই বক্তব্যে জাতীয় সরকারের রূপরেখা নেই। প্রথমত জাতীয় সরকারের প্রধান হবেন কে? যদি ধরে নেওয়া হয় যে বিএনপি এই জোটের মধ্যে একটি বড় রাজনৈতিক দল, তাহলে বিএনপি চেয়ারপারসন অথবা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সরকার প্রধান হবার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো উভয় নেতাই মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ফলে যতদিন পর্যন্ত মামলা আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি না হচ্ছে, কিংবা  উচ্চ আদালতে আপিলের মাধ্যেমে তারা খালাস না পাচ্ছেন-ততদিন পর্যন্ত তাদের পক্ষে সরকার প্রধান হওয়া তো দূরের কথা সংসদ সদস্য হওয়া সম্ভব নয়।  তাছাড়া বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আইনি লড়াই লড়তে হলেও দেশে আসতে হবে। দেশে আসলে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হবে– এটিই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যদি জাতীয় সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েও যান তাহলে সরকার প্রধান কে হবে এই বিষয়ে দলের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেবে। বর্তমানে দলে যে পরিমাণ নেতৃত্বে বিভক্তির রয়েছে, সেই অবস্থায় দলের মধ্যে থেকে সরকার প্রধান নির্ধারণ করা একটি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে তাদের জন্য। ফলে রূপরেখা ছাড়া জাতীয় সরকার গঠনের দাবি একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত একটি দাবি।

বিএনপি ছাড়া এই জোটের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য যে রাজনৈতিক দলের নেতারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন তাদের অনেকেরই সংসদের কোনও প্রতিনিধিত্ব কখনোই ছিল না।  আবার অনেকেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন যাদের দেশের কোনও অঞ্চলেই সমর্থক নেই। এই ধরনের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সব সময় বড় রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে চলতে চায়। এই নেতারা আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির কাঁধে ভর করে কখনও কখনও এমপি অথবা কখনও কখনও মন্ত্রী হন। বিএনপির জোটে যে সমস্ত রাজনৈতিক দল রয়েছে তাদের অধিকাংশেরই ব্যাপক জনসমর্থন নেই। ফলে তাদের মুখে যখন এ ধরনের দাবির কথা উচ্চারিত হয় সেটি জনগণের কাছে হাস্যকর মনে হয়। যে রাজনৈতিক জোট গত ১৩ বছরে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি তারা কীভাবে সরকারকে উৎখাত করে দেশে জাতীয় সরকার গঠন করবে এই বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়।

রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্যই থাকে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের কল্যাণ করা।  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচন। বছরের পর বছর নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকে অন্য কোনও পন্থায় ক্ষমতায় যাওয়া বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে খুব কঠিন একটি কাজ। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে বিরোধীদলের অস্তিত্ব সংকট তৈরি করেছে দেশে। আমরা সকলেই জানি বিরোধী দল হচ্ছে সংসদের প্রাণ। সংসদে সরকারি দলের আধিপত্য থাকলেও বিরোধী দল সংসদে অবস্থান করে সরকারের সকল মন্দ কাজের সমালোচনা করবে– এটি বাস্তবতা। কিন্তু নির্বাচনের সময় নির্বাচন বর্জনের রাজনীতি বিরোধী দলগুলোকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। ফলে দেশে রাজনীতিতে একটি দলের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে এবং বিরোধী দলের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বয়কটের সংস্কৃতি।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত ১৩ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করেছে তা বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থনীতি, সামাজিক সুরক্ষাসহ করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য খাতের বিপর্যয়কে যে ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সামাল দিয়েছেন– সেটি সত্যিই বিস্ময়কর। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বা মন্ত্রী সমালোচনার পাত্র হয়েছেন তাদের কর্ম এবং বক্তব্যের জন্য। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে নেতৃত্বে গুণের কারণে। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা এবং যোগ্যতা দিয়ে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাবার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনে জনগণ তাঁর ওপরে আস্থা রাখবে বলে বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে।

বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সংস্কৃতি এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে আগামী ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে– এটি সকলের প্রত্যাশা। কারণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতায় আসলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংঘটিত হয়। ফলে অন্য কোনও উপায়ে সরকারে আসার পরিকল্পনা না করে বিরোধী দলের উচিত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে নেওয়া। বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার বিরোধী জোটের স্বপ্ন বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ