X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণ বন্ধ না হলে চামড়া ব্যবসায় সুদিন ফিরবে না

আমীন আল রশীদ
১১ জুলাই ২০২২, ১৯:০৪আপডেট : ১১ জুলাই ২০২২, ২০:৪৬

সবশেষ আপনি একজোড়া চামড়ার জুতা যে দামে কিনেছেন, দশ বছর আগে এই মানের জুতার দাম কি কম ছিল? নিশ্চয়ই না। অর্থাৎ চামড়ার জুতার দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। কিন্তু দশ বছর আগে পশুর চামড়ার যে দাম ছিল, এখন সেই তুলনায় দাম অনেক কম। যদি জুতার কাঁচামালের দাম কম হয়, তাহলে জুতার দাম কেন বেশি—নাগরিকদের মনে এই প্রশ্নটি আছে। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কেন পশুর চামড়ার দাম তলানিতে এবং এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কারা?

ঈদের দিন ফেসবুকে একজন লিখেছেন: ‘গরুর চামড়া খাওয়ার কোনো রেসিপি থাকলে সাজেস্ট করেন। না হয় চামড়াটি মাটিতে পুঁতে ফেলবো।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘ছাগলের চামড়া ১৫ টাকা। গরু ৩০০-৩৫০ টাকা। ফ্রি নিলেই পারে।’

কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে মানুষের এসব রসিকতার পেছনে রয়েছে কিছু নির্মম বাস্তবতা। বেশ কয়েক বছর ধরেই পশুর চামড়ার দাম নিয়ে যে হতাশা, সাধারণ মানুষের এসব প্রতিক্রিয়া মূলত তারই ধারাবাহিকতা।

এ বছর ঢাকার মধ্যে সরকার নির্ধারিত প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা।

গত কয়েক বছরের খরা কাটিয়ে এ বছর একটু ভালো দাম পাবেন, এই আশায় কোনও কোনও মৌসুমি ব্যবসায়ী কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকায় প্রতিটি গরুর চামড়া কিনেছেন। তবে আড়তদাররা কিনেছেন ২০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকার মধ্যে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, চট্টগ্রামে প্রতি পিস চামড়া বিক্রি হচ্ছে আকারভেদে ১০০ থেকে ২৫০ টাকায়। দাম কম হওয়ায় চামড়া বিক্রি নিয়ে আগ্রহ কম কোরবানিদাতাদের। তাই অনেকে চামড়া বিক্রি না করে এতিমখানায় দান করে দিয়েছেন। কোথাও কোথাও কোরবানি গরুর চামড়া কেনার জন্য কেউ না আসায় গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হয়েছে।

ন্যায্য দাম না পেয়ে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের মাথায়ও হাত। কারণ, চামড়া কেনার পরে সেগুলো আড়তদারদের কাছে নিয়ে যেতে যে পরিবহন খরচ, সেটিও ওঠে না। ফলে অনেকে লোকসান গুনছেন। এই লোকসানটি কয়েক বছর ধরেই পৌনঃপুনিকভাবে চলছে। অনেক মৌসুমি মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের প্রচুর টাকা বকেয়া আড়দতারদের কাছে। চামড়া ব্যবসার এটিও বিরাট সংকট। প্রতি বছরই তারা বকেয়া পাবেন এই আশায় থাকেন। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীরা বকেয়া পরিশোধ করতে পারেন না। ছোট ব্যবসায়ীদেরও সংকট কাটে না।

এ বছর আশা করা হয়েছিল গত কয়েক বছরের খরা কাটিয়ে এবার হয়তো চামড়ার ব্যবসা আলোর ‍মুখ দেখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলো আসেনি।

কেন আসেনি তার বড় কারণ চামড়ার দাম নির্ধারণ এবং এর বাস্তবতা। একটি মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার আয়তন ২৫ বর্গফুট। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দর অনুযায়ী লবণযুক্ত সেই চামড়ার দাম হয় ১ হাজার ২৩৭ টাকা। সেখান থেকে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে লবণবিহীন কাঁচা চামড়ার দাম হওয়ার কথা ৯৩৭ টাকা। অথচ কোরবানির দিন রাজধানীর পোস্তায় মাঝারি আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৭৫০ টাকায়। তাহলে প্রতি বর্গ ফুট চামড়ার দাম নির্ধারণের অঙ্কটিই কি ত্রুটিপূর্ণ?

চামড়ার দাম নিয়ে কেন এই হতাশা—তার উত্তর খুঁজতে গেলে জানা যাবে, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম পড়ে গেছে। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের ট্যানারি মালিকরাই। হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীতে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনছে না। এখন বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়লেও দেশের চামড়ার বাজার শুধু চীনকেন্দ্রিক হওয়ায় সেই সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না।

চামড়া ব্যবসার সংকটের পেছনে আরেকটি বড় কারণ ট্যানারির মালিকেরা বকেয়া টাকা না দেওয়ায় অনেক আড়তদার ও চামড়া ব্যবসায়ী এই ব্যবসা থেকে সরে গেছেন। তাছাড়া চামড়ায় ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের কেমিক্যালের (রাসায়নিক) দাম বাড়ার পাশাপাশি লবণের দামও বেড়েছে। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কাঁচা চামড়ার দামে।

ট্যানারির মালিকেরা চামড়া কিনতে এসে ‘চামড়ার মান ভালো না’সহ নানা অজুহাতে দাম কমিয়ে দেন। ফলে আড়তদাররা কাঙ্ক্ষিত দাম পান না। আবার খুচরা ব্যবসায়ীদের বড় অভিযোগ, সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চামড়া কেনেন। ফলে তারাও দাম পান না। তার মানে প্রত্যেকটা জায়গায় এই সিন্ডিকেটের কারসাজিও চামড়া ব্যবসায় ধসের বড় কারণ।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. ওমর ফারুক ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন, পানির দাম আছে, কিন্তু চামড়ার দাম নেই। গত এক বছরে সবকিছুর দাম বাড়ছে, চামড়ার দাম বাড়েনি। যে চামড়া ২ হাজার টাকায় বিক্রির কথা, সেই বড় চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। এর পেছনে তিনি সরকারের তদারকি না থাকাকে দায়ী করেন।

তবে পশুর চামড়ার ব্যবসার সংকট নিয়ে আলোচনায় যে বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি সামনে আসছে তা হলো, ট্যানারির দূষণ। রাজধানীর হাজারিবাগে ট্যানারি কারখানাগুলোকে ঢাকার লাইফলাইন বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়। এখান থেকে ঢাকার অদূরে হেমায়েতপুরে ট্যানারি কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়ার পরে ধলেশ্বরী নদীও দূষিত হয়েছে। ওই এলাকার মানুষের জীবন ‍দুর্বিষহ ট্যানারির বর্জ্যে। নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেতও। একসময় যে নদীর জল ছিল টমটলে; যেখানে স্থানীয় মানুষেরা মাছ ধরতেন; গোসল করতেন, এমনকি রান্নার কাজেও ব্যবহার করতেন যে নদীর পানি—সেই নদীর পাশ দিয়ে এখন হেঁটে গেলে নাক চেপে ধরতে হয়। ট্যানারির অপরিশোধিত বর্জ্য হাজারীবাগের পরে ধলেশ্বরী তীরের বিরাট এলাকার মানুষের জীবনও বিপন্ন করছে। এর মূল কারণ কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট অকার্যকর। খরচ বাঁচানোর জন্য কারখানার মালিকরা ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলেন।

এরকম বাস্তবতায় ট্যানারি কারখানা বন্ধেরও সুপারিশ করেছে জাতীয় সংসদের পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। যদিও এটা কোনও সমাধান নয়। কারণ দেশের অর্থনীতিতে ট্যানারি শিল্পেরও ভূমিকা রয়েছে। অতএব, শিল্প কারখানা যেমন রক্ষা করতে হবে; ট্যানারি মালিকদের যেমন বাঁচাতে হবে; তারা যাতে রফতানি আয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন সেই সুযোগ ও নীতিমালা যেমন রাষ্ট্রকে প্রণয়ন করতে হবে; খুচরা পর্যায়ে ছোট ছোট বা মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, তারা যাতে চামড়ার ভালো দাম পান, সেটি যেমন নিশ্চিত করতে হবে—তেমনি শিল্প ও অর্থনীতির দোহাই দিয়ে দেশের নদী-পরিবেশ-প্রাণ-প্রকৃতি যাতে ধ্বংস না হয়, সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে ট্যানারি কারখানা হেমায়েতপুরে সরিয়ে নিয়ে ধলেশ্বরী নদী দূষিত করা হলে যে লাউ সেই কদু।

মনে রাখতে হবে, ট্যানারি মালিকরাও এই জনপদেরই সন্তান। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী বাঁচানোর দায় তাদেরও। তাদের শিল্পের কারণে এরকম গুরুত্বপূর্ণ দুটি নদী তো দূরে থাক, একটি ছোট্ট খাল বা জলাশয়ও যদি দূষিত হয়, সেটিও দুঃখজনক। তাদের নদী খাল প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করেই ব্যবসা করতে হবে। আইন ও নিয়ম-কানুন মেনেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

উন্নয়ন হবে, কিন্তু সেই উন্নয়নের বিনিময়ে নদী খাল ও পরিবেশ বিসর্জন দিতে হবে—এমন উন্নয়ন আমরা চাই না। অর্থনীতির সঙ্গে পরিবেশের সংঘাত কারও কাম্য নয়। বরং এ দুটির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই পারে একটি দেশের অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার লাইফলাইনগুলোও সচল রাখতে। সেজন্য রাষ্ট্রকে যেমন পরিবেশবান্ধব নীতিমালা করতে হয়, তেমনি সেই নীতিমালা বাস্তবায়নে কঠোরও হতে হয়। সেইসঙ্গে শুধু নদী তীরবর্তী মানুষেরাই নন, সারা দেশের মানুষকেই প্রতিটি নদী খাল জলাশয় হাওর ও বন রক্ষার বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়। বরিশালের মানুষ শুধু কীর্তনখোলা বা ধানসিঁড়ি বাঁচানোর দাবিতে সোচ্চার থাকবেন, কিন্তু বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর বিষয়ে চুপ থাকবেন, এটি যেমন কাঙ্ক্ষিত নয়, তেমনি বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী পাড়ের মানুষকেও উত্তরবঙ্গের নদীগুলোর বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ থাকতে হবে। কারণ দেশটা সবার। এই দেশে একজন রাজনীতিবিদ, একজন সাংবাদিক বা একজন পরিবেশকর্মীর যে অধিকার ও দায়িত্ব, তেমনি একজন চামড়া ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরও সেই অধিকার। সুতরাং চামড়া ব্যবসা বিকশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ট্যানারি শিল্পের বিকাশ যেমন দরকার, তার চেয়ে বেশি জরুরি নদী ও প্রাণপ্রকৃতির সুরক্ষা।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নজনিত বিপদ মাথায় রেখে সারা বিশ্বের ক্রেতারা এখন পরিবেশ ইস্যুতে সোচ্চার। সুতরাং, বাংলাদেশ যদি তার শিল্পকারখানার উন্নয়নের বিনিময়ে নদী পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়; যদি আন্তর্জাতিক ক্রেতারা পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে তারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনতে আগ্রহী হবে না। আর শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নির্ভর করে চামড়া শিল্প যে বিকশিত হবে না—সেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং দেশের শিল্প কারখানা ও অর্থনীতির বিকাশের বিপরীতে পরিবেশের বিষয়টি যদি অগ্রাধিকারে না থাকে, তাহলে দেশের চামড়া ব্যবসায় কোনও আলো আসবে না।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

/এসএএস/এমওএফ/এমএম/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ