X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ কামাল একটি আদর্শের নাম

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
০৪ আগস্ট ২০২২, ১৮:৫৩আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২২, ১৯:৩৪
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্ম ৫ আগস্ট ১৯৪৯ সালে টুঙ্গিপাড়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার থেকে দুই বছরের ছোট শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তান শেখ কামালের জন্মগ্রহণ প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, ‘মন চলে গিয়েছে বাড়িতে। কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না। অনুভব করতে লাগলাম যে আমি ছেলেমেয়ের পিতা হয়েছি।’

নিরহংকার শেখ কামালের জীবন অধ্যায়ের শুরুর কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আরও লিখেছেন, ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’

বাংলাদেশে তারুণ্যের প্রতীক শেখ কামাল, নিজ মেধা-মনন-কর্মে আলোকিত হয়েছেন এবং সদ্য স্বাধীন দেশের তরুণদের আলোর পথ দেখিয়েছেন। পড়াশোনা থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ ক্রীড়াঙ্গনেও তিনি উজ্জ্বল হয়ে বিচরণ করেছেন। তিনি একসঙ্গে অনেক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন, ছিলেন ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা, সেনা কর্মকর্তা, সেতারবাদক, বিতার্কিক, গায়ক এবং অভিনেতা।

তাঁর সময়ে শেখ কামাল ছিলেন আধুনিক ও সময়ের চেয়ে আগানো তারুণ্য, যা অপকটে তাঁর পরিচিত ও বন্ধুজনেরা আজও স্বীকার করেন। জাতির পিতার সন্তান হয়েও তিনি ছিলেন অমায়িক, ভদ্র এবং বন্ধুবাৎসল। এক বহুমাত্রিক প্রতিভা শেখ কামাল, যিনি আজ বেঁচে থাকলে দেশ ও জাতিকে আরও বহু শুভ ও সাফল্যময় র্কীতি উপহার দিতে সক্ষম হতেন। জাতির পিতার পরিবারে জন্ম নিয়েও অহংকার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি বরং জীবনাচার ছিল খুবই সহজ-সরল ও সাদামাটা, যা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবার মধ্যেই ছিল এবং এখনও আছে। যারাই তাঁর সাথে মিশেছে বা চলেছে তাঁর গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়েছে।

বিনয়ী, ভদ্র ও স্বল্পবাক শহীদ শেখ কামালসহ ভাই-বোনদের শৈশবের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন ছিলাম। একসঙ্গে উঠাবসা, খেলাধুলা, একসঙ্গে চলাফেরা, ঝগড়াঝাঁটি সবই আমরা করতাম। একসঙ্গে সাইকেল চালানো, একসঙ্গে ক্রিকেট খেলা, ব্যাডমিন্টন খেলা সবই করতাম। যেহেতু আমরা দুই ভাইবোন কাছাকাছি, আমার পুতুল খেলাতেও কামাল যেমন আমার সঙ্গে থাকত, ছোটবেলা থেকে বাকি সব খেলায় আমিও ওর সঙ্গে একসঙ্গে খেলতাম।’ বাবা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) কখনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি সেজন্য অর্থ-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে শেখ কামালের কোনও নজর ছিল না। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, আমার ছোট ভাই, আমি নিজে বলতে পারি শেখ কামাল অত্যন্ত সাদাসিধা জীবনযাপন করতো। সে একজন সাংস্কৃতিকমনা আবার রাজনীতিবিদ, কখনও বিলাস-ব্যাসন এসব দিকে তার দৃষ্টি ছিল না।

আপন আলোয় উদ্ভাসিত শেখ কামালের এক বন্ধু লিখেছেন, ‘আমি যতই তাঁর কাছে যাই, তাঁর আচার-আচরণে মুগ্ধ হই। বঙ্গবন্ধুর সন্তান ছাড়াও যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলেও বলতে হবে, ব্যক্তি কামালের মতো সৎ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ তৎকালীন সময়ে খুব দুর্লভ ছিল।’ তিনি ছোটবেলা থেকেই দায়িত্ববান ছিলেন এবং সাংসারিক কাজে তাঁর মা বেগম ফজিলাতুন নেছাকেও নিয়মিত সহযোগিতা করতেন।

সাহসী শেখ কামাল রাজপথে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান এবং মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। দেশ স্বাধীনের ব্রত নিয়ে তিনি ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঐতিহাসিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসভবনে আক্রমণ করার পূর্ব মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। বাসা ছাড়ার পর কিছু দিন ধানমন্ডিতে একটি সুইস পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করেন। ছদ্মবেশে এপ্রিলের মাঝামাঝি গোপালগঞ্জে যান। সেখান থেকে ফুফাতো ভাই ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীসহ ওড়াকান্দির ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দেবহাটা-হাসনাবাদ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যান। পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছানোর পর সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলে মিসেস গান্ধী তাকে সেখানে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রস্তাব দেন এবং লেখাপড়া শুরু করার কথা বলেন। কিন্তু কামাল তাঁকে ধন্যবাদ জানায় এবং সরাসরি বলে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবেন। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর থেকে অত্যন্ত চৌকস এবং মেধাবীদের মধ্য থেকে ৬১ জনকে নির্বাচিত করে ভারতের অফিসার ট্রেনিং উইংয়ে ন্যস্ত করে। বর্তমান উত্তরাখণ্ড প্রদেশের দেরাদুনে মূর্তি ক্যাম্পে প্রেরণ করে তাদের।

তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহের জন্য গঠন করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। এই দলের মোহনবাগানের সঙ্গে দ্বিতীয় খেলায় সেসময় মাঠে উপস্থিত ছিলেন শেখ কামাল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ধানমন্ডির ১৮ নম্বর সড়কের বাসায় ফেরেন। তখনও তাদের পরনে ছিল সামরিক পোশাক। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ২ বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়েছিল। সে কারণে শেখ কামালকেও ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লে. শেখ কামাল ‘ক্যাপ্টেন’ হিসেবে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে লেখাপড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর আগে ঢাকার শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে বিএ অনার্স পরীক্ষা পাস করেন। তবে ১৯৬৯ সালে তিনি ভর্তি হন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্নাতক (সম্মান ) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মাস্টার্স পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন শিক্ষা সংস্কারে কাজ করেছেন।

তিনি শৈশব থেকে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, বাস্কেটবলসহ নানারকম খেলাধুলায় প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন। ফলে হয়ে ওঠেন দারুণ ক্রীড়াবিদ। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আধুনিকতার প্রতীক তিনি। ধানমন্ডি এলাকায় খেলাধুলার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। শেখ কামাল সেজন্য উদ্যোগ নেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ধানমন্ডি ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক হন। স্বাধীনতা পর ১৯৭২ সালে তিনি ‘আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি’ গঠন করেন, যা তিন বছর পর হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র। শেখ কামাল ও আবাহনী একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এ দেশের ফুটবলকে আধুনিকতার স্পর্শ দেন তিনি। ১৯৭৩ সালে আয়ারল্যান্ড থেকে প্রথম বিদেশি কোচ বিল হার্টসকে দেশে এনে ফুটবলে নবধারা তৈরি করেন। তিনি আমৃত্যু ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতেন এবং নিজেও তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন। তিনি দীর্ঘদিন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন এবং ক্রিকেটের উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের জন্য অনেক কাজ করেছেন এবং পরিকল্পনাও করেছিলেন। খেলোয়াড়দের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে উদ্যোগ নেন এবং তাদের জন্য অবসর ভাতা প্রদানেরও উদ্যোগ নেন। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার জন্য তিনি জাতির পিতার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার অনুদান নিয়ে ‘খেলোয়াড় কল্যাণ তহবিল’ গঠন করেছিলেন।

১৯৭৫-এর ১৪ জুলাই শেখ কামালের ও ১৭ জুলাই জামালের (শেখ জামাল) বিয়ে হয়। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেসময় শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানি যাবার সময় শেখ কামালকে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার জন্য কী আনব?’ উত্তরে শেখ কামাল বলেছিল, আমার জন্য না, আমার আবাহনীর খেলোয়াড়দের জন্য বুট নিয়ে এসো। তখন ডায়েরিতে নামটাও লিখে দেয় এডিডাসের বুট।’ নিজের প্রতি নয়, খেলাধুলা ও মানুষের জন্যই ছিল তার প্রবল আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক অবিস্মরণীয় নাম শেখ কামাল।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও শেখ কামালের ছিল দৃপ্ত পদচারণা। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার রবীন্দ্রসংগীতকে এ দেশে সেসময় নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে তিনি মৃদঙ্গ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন করেন। অভিনেতা হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল তাঁর। নাটক, বিশেষ করে মঞ্চনাটকে দারুণ অভিনয় করতেন, ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অভিনেতা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনেও ভালো প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ডাকসুর উদ্যোগে পেশাদারী নাট্য সংস্থা ‘নাট্যচক্র’ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন শেখ কামাল। ‘এক নদী রক্ত’, ‘পলাতক’, ‘আমি মন্ত্রী হবো’, ‘অতৃপ্ত কান্না’, ‘ইতিহাসের জয় জনতার জয়’ সহ বিভিন্ন মঞ্চ নাটকে তিনি অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন। কলকাতাতেও মঞ্চনাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। সে ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সংস্কৃতি বিনিময় মেলায় অংশগ্রহণ করে। সেখানে জর্জ বার্নাড শ-এর লেখা ‘You Never Can Tell’ অবলম্বনে ‘কেউ কিছু বলতে পারে না’ নাটকের মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে। সংগীতানুরাগী শেখ কামাল ভালো সেতার বাজাতেন, যা তিনি শিখেছিলেন ছায়ানট থেকে।

বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী, যার মাধ্যমে বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল।

তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন এবং মৃত্যুর সময়ও বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সদ্য-স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচির পাশাপাশি সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তিনি কাজ করেছেন।

শেখ কামাল যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন তখন পরিচয় হয় একই বিভাগের ছাত্রী, ক্রীড়াবিদ সুলতানা খুকীর সঙ্গে, যাকে সবাই পূর্ব পাকিস্তানের গোল্ডেন গার্ল (Golden Girl of East Pakistan) বলে ডাকতো। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘটে মানব ইতিহাসের নৃশংস্যতম হত্যাকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি, দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল জাতির পিতাকে সপরিবাকে হত্যা করে। সেই বর্বরতম ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে শেখ কামাল ও সুলতানা কামাল খুকীও নিহত হন। সে সময় দু’জনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করেছিলেন। তবে সুলতানা কামাল ভাইভা পরীক্ষা দিতে পারেনি। ভাইভা হওয়ার আগেই বুলেট তার জীবন কেড়ে নিয়েছিল। তাদের ফল প্রকাশের আগেই তারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরের বছর যখন ফল প্রকাশ হয় তখন জানা যায় শেখ কামাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

মাত্র ২৬ বছরের জীবন ছিল শেখ কামালের। এই অল্প সময়ে তিনি সবার হৃদয় জয় করেছেন। সাদামাঠা জীবনাচারের পাশাপাশি তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল খুবই সাধারণ। অমিত প্রাণশক্তি ছিল তাঁর মাঝে, আধুনিকতা ও উচ্চ মননশীলতার প্রতীক ছিলেন তিনি। আগস্টেই এই মেধাবী-প্রতিভাবান ব্যক্তির জন্ম হয়, আগস্ট মাসেই ঘাতকের বুলেট তাঁর প্রাণ নিয়ে নেয়। ১৫ আগস্টে শেখ কামালকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামালের সঙ্গে ওসমানীর এডিসি ছিল, পলাতক খুনি নূর চৌধুরী। ১৫ আগস্টের কালরাতে যখন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নং বাড়িতে আক্রমণ করা হয় তখন প্রথমেই শেখ কামাল নিচে বারান্দায় চলে যায় এবং তিনি দেখেন যে খুনি নূর ও হুদা একসঙ্গে ঢুকছে। তখন শেখ কামাল তাদের বলে, “আপনারা এসে গেছেন? খুব ভালো হয়েছে। দেখেন বাসায় কারা আক্রমণ করছে।” এর সাথে সাথেই নূরের হাতের অস্ত্রই গর্জে ওঠে এবং ওখানেই শেখ কামালকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

অত্যন্ত মেধাবী ও পরিমিতবোধসম্পন্ন শেখ কামাল আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতেন এবং পরিকল্পনা করে কাজ করতেন, যা তাঁর ২৬ বছরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। সময়ে থেকে এগিয়ে থাকা এই মানুষ ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত, পরিশ্রমী এবং দূরদর্শী।

১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটা চক্রান্ত করে শেখ কামালকে গুলি করা হয় এবং হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে বেঁচে যায়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও শহীদ শেখ কামালকে নিয়ে অনেক অপপ্রচার চালানো হয়। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সেনাশাসক জিয়াউর রহমান নানা কূটকৌশল করে শেখ কামালের বিরুদ্ধে যেসব কুৎসা রটায় তার কোনও কিছুরই সত্যতা কোনোদিন পাওয়া যায়নি। কোনও মিথ্যাচার শেখ কামালের কীর্তিকে ম্লান করতে পারেনি।

তিনি জাতির পিতার সন্তান হয়েও ছিলেন সৎ, বিনয়ী, নির্লোভ, পরোপকারী ও অহমিকাহীন মানুষ এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য সবসময়ই অনুসরণীয়। তিনি নিজ কর্মগুণে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। শেখ কামাল ছিল তারুণ্যের রোল মডেল। তার জীবদ্দশায় এমনকি একালেও অনেকেই তাকে অনুকরণ করে। সে কারণেই শেখ কামাল ছিল উত্তরাধুনিক। আজকের ছাত্র, যুবক ও তরুণদের জন্য শেখ কামাল একটি আদর্শের নাম। শেখ কামাল স্বীয় কর্মগুণে যুব সমাজে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তাঁর ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে জানাই অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী।

তথ্যসূত্র:

১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।

২. ০৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে শহীদ শেখ কামালের ৭১তম জন্মদিন উপলক্ষে ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ।

৩. দৈনিক জনকণ্ঠ, ০৬ আগস্ট ২০২০।

৪. ০৫ আগস্ট ২০২০, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা।

৫. ডাকসু সংগ্রহশালা।

৬. দৈনিক যুগান্তর, ৬ আগস্ট ২০২১।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ