X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

যে কারণে ইরানের নারীদের পক্ষে বিশ্বকে দাঁড়াতে হবে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৫ অক্টোবর ২০২২, ১৭:২২আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১৭:২২

হিজাব ঠিকমতো না পরে পথে বের হওয়ায় ইরানের রাজধানী তেহরানে মাহশা আমিনি নামের এক তরুণীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের হেফাজতেই শারীরিক নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর তাকে আটক করার পর ১৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয়। এরপর থেকে অসন্তোষের আগুনে জ্বলছে ইরান। রাস্তায় নেমে হিজাব পোড়ানো থেকে শুরু করে মাথার চুল কেটে ফেলার মতো নানা অভিনব প্রতিবাদ করছেন নারীরা। পথে নেমে এসেছেন পুরুষরাও। ইরানে নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্বে একটি পুলিশ বাহিনী আছে, যাদের কাজই হলো নারীদের এমন ভয়ংকর শাসনে রাখা এবং এদের নিষ্ঠুরতার নানা প্রমাণ থাকলেও কোথাও জবাবদিহি করতে হয় না।

মাহশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে পথে নেমে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা শত ছাড়িয়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের রোষের মুখে পড়ে মৃত্যু হচ্ছে নিরাপত্তারক্ষীদেরও। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে এবং সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেও ইরানের ইসলামি সরকার বিক্ষোভ দমাতে পারছে না। নিহতের পাশাপাশি জেলখানা ভরে উঠছে প্রতিবাদী মানুষের গ্রেফতারে। মাহশা আমিনি হত্যার খবরটি বাইরের পৃথিবীকে জানানোর কারণে নিলুফার হামিদি নামের এক সাংবাদিককেও গ্রেফতার করেছে ইরান সরকার। ২০১৯ সালের পর এটি ইরানে সবচেয়ে বড় জনবিক্ষোভ। সে বছর জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমে এলে শক্তহাতে দমন করে ইরান সরকার। তখন কমপক্ষে ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়, অজস্র মানুষকে গুম করা হয় আর হাজার হাজার মানুষকে জেল খাটতে হয়।

১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের পর সবচেয়ে নির্মম জীবনযাপন করছেন ইরানের নারীরা। এত কঠোর বিধিনিষেধ এর আগে কখনও দেখেননি ইরানের নারীরা। এই তথাকথিত বিপ্লবের আগের ইরানের ছবি কিন্তু একটি আধুনিক ও উদার সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ইরানের এখনকার শাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত নিষ্ঠুর, বিচার ব্যবস্থা ভয়ংকরভাবে মানুষবিরোধী।

সরকারের পক্ষ থেকে এই বিদ্রোহকে সমূলে উৎখাতের চেষ্টা করা হচ্ছে। সারা দেশে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশসহ আধা সামরিক নিরাপত্তা বাহিনী। বহির্বিশ্বের কাছে ইরানের বর্তমান পরিস্থিতির চেহারা ধামাচাপা দিতে ইন্টারনেটও অচল করে রেখেছে সরকার। তবু খবর আসছে ইরান থেকে।

যে ইরানবাসী রেজা শাহ পাহলভীর রাজতন্ত্রকে হটিয়ে ছিলেন এবং ভেবেছিলেন ইরানে ন্যায্যতা আসবে, তারা এখন দেখছেন আসলে পুরো দেশ নিপতিত হয়েছে অন্ধকারের শক্তির হাতে। ইরানে নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক এবং সেটা এমনভাবে পরতে হবে যেন মাথার সামান্য চুলও দেখা না যায়। মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর খোদ ইরানের মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে, ‘সামান্য চুল দেখা গেলেই ধর্ম শেষ হয়ে যায়’? আসলে হিজাব একটি প্রতীক মাত্র। ইরানের মানুষকে, বিশেষ করে নারীদের, নিপীড়নের মধ্যে রাখার জন্য নিষ্ঠুরতম নানা পন্থা অবলম্বন করে থাকে ইরানের এই নীতি পুলিশ। ইরানে এখন মানুষ বলতে শুরু করেছেন, হিজাব পরা একজন নারীর পছন্দ হতে পারে  নাও হতে পারে, রাষ্ট্র কেন জোর করে তা চাপিয়ে দেবে?

ইরানের নারী-পুরুষের এবারের আন্দোলনকে শুধু তাই হিজাববিরোধী আন্দোলন হিসেবে দেখলে ভুল হবে। দেখতে হবে মানুষের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার দাবির আন্দোলন হিসেবে। এই হিজাব পুড়িয়ে ফেলাকে দেখতে হবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের আন্দোলন হিসেবে, ইসলামবিরোধী কোনও কাজ হিসেবে নয়। ইরানে নারীবিরোধী রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এমন পর্যায়ে আছে যে সেখানে অমুসলিম নারীও হিজাব পরতে বাধ্য। সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই ইরানের এখনকার প্রতিবাদ আসলে দেশটির মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন।

বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। প্রবাসী ইরানিদের পাশাপাশি নানা দেশের মানুষ ইরানের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। সমাবেশ হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপে। ইরান সরকার এতটাই মরিয়া হয়েছে যে বিক্ষোভ দমাতে নামিয়েছে নারী নিরাপত্তারক্ষীদের। বোরকায় ঢাকা পুরো শরীর, কিন্তু কাপড়ের তলেই আছে রাইফেল। রাস্তায় নেমে এরা খুন করছে বিক্ষোভরত নারী-পুরুষদের।

ইরানে ৮০টির বেশি শহরজুড়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী এবং পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ক্রমেই আরও সহিংস হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে, কোনও লাঠিচার্জ নয়, সতর্ক বার্তা নয়, বিক্ষোভ সমাবেশে সরাসরি গুলি চালাচ্ছে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। তবু রাজধানী তেহরানসহ প্রায় সর্বত্র লাখ লাখ মানুষ  নিরাপত্তা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করছেন এবং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলি খামেনির বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন।

ইতিহাস বলে ১৯৭৯ সালে খামেনির শাসন শুরু থেকেই ইরানের নারীদের কঠোর নিয়ম-কানুন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ ও নিপীড়নের ভেতর থাকতে হচ্ছে। তাই ইরানের নারী ও জনগণের এবারের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে হবে পুরো বিশ্বকে, যারা উদার ও প্রগতিশীল সমাজ কামনা করেন। ইরানের নারীরা সাহস করে রাজপথে নেমেছেন, তাই পুরুষও নেমেছেন। ইরানের নারীদের এই আন্দোলনের সফলতা বিশ্বের নানা প্রান্তে ধর্মীয়, আর্থসামাজিক নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে নারীর ওপর যে নির্যাতন চলে তার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে সাহায্য করবে।

লেখক: সাংবাদিক  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ