X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্বকাপ ফুটবলে কি পরিসংখ্যানিক মডেলগুলো কাজ করবে?

ড. মো. হাসিনুর রহমান খান
০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:১৯আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:১৯

বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই বাঙালির বড় বড় উৎসবের মতো উন্মাদনা, আমেজের এক মধুর আবহ ধারা তৈরি হয়। উৎসব চলে মাসব্যাপী। এই দীর্ঘ উৎসব পালনে ক্লান্তির ছোঁয়াও লাগে না, বরং উত্তর উত্তর উচ্ছ্বাসের চূড়ার দিগন্ত মিলে। প্রায় সব খেলাভক্তের মুখের বুলি আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। শিশু, সদ্য তরুণ, তরুণ, যুবক, মধ্য বয়সীদের মধ্যে অনিন্দ্য উচ্ছ্বাসের স্রোতস্বিনী নদীর মতো বহমান থাকে, মাঝে মধ্যে কখনও কখনও শুধু গতি কিংবা দিক বদলায় মাত্র প্রিয় দল হারা-জিতা-ড্রয়ের মধ্য দিয়ে।

নিজের দল হারলে বিষাদ, জিতলে আনন্দ। তাই বিষাদ এবং আনন্দের মিশেলে এক অভূতপূর্ব প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায়। বৈচিত্র্যময় অথচ সহজ সাধারণ খেলাগুলোর মধ্যে ফুটবল খেলাই সবার চেয়ে এগিয়ে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত, ধনী-দরিদ্র, দেশ-বিদেশ ভেদে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। এ নিয়ে কারোরই সন্দেহ নেই। পরম পছন্দের দলই বনে যায় নিজের দল। একান্ত আপন কিংবা স্পর্শকাতর করে নেওয়ায় দল সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী করলে ভক্তরা তা সহজে মেনে নিতে পারেন না, বিরুদ্ধাচরণ করেন। পরিচিত এমন অনেকের তিক্ত অনুভূতির কথা অনেকেরই জানা আছে।

কিন্তু যখন পরিসংখ্যানিক বা গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তখন কখনও কখনও দেখা যায় আবেগের কাছে বিজ্ঞানের পরাজয় ঘটে বিজ্ঞানকে ছোট করে দেখার কারণে। আবেগের গুরুত্বের কাছে গুরুত্বহীন হয় যুক্তি, যা কখনোই প্রত্যাশিত নয়। প্রিডিকশন বা ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা পূর্বাভাস যাই দেওয়া হোক না কেন তা সবসময়ই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনেই করা হয়। যুক্তি, সম্ভাবনা, আর গাণিতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার সমীকরণকে পরিসংখ্যানিক বা গাণিতিক মডেল বলা হয়। এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে এমন সব ডজন-ডজন প্রিডিকশন মডেলের কথা জানা যায়। যেখানে কে হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ, এক রাউন্ড থেকে আরেক রাউন্ডে উত্তীর্ণ ইত্যাদি নানা ভবিষ্যদ্বাণী থাকে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম রাউন্ড শেষে শুরু হয়েছে নকআউট পর্ব। যেকোনও একদল টিকে যাবে, অন্যটি হেরে যাবে। ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রিডিকশন মডেলের কর্ম দক্ষতার ব্যবচ্ছেদ ঘটেছে বস্তুত জার্মানি, বেলজিয়াম, মেক্সিকো ও উরুগুয়ে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়ার মধ্য দিয়ে। আমার জানা মতে এমন কোনও মডেল নেই, যারা এই দেশগুলোকে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল।
সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, অতীত ইতিহাস, খেলোয়াড়দের যোগ্যতা-দক্ষতা, পেশাদারিত্বের অভিজ্ঞতা, ঘরে-বাইরে খেলার অভিজ্ঞতা, সাম্প্রতিক বিশ্ব র‌্যাংকিং, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যেকোনও মডেলের এমনই পূর্বাভাস হওয়ার কথা।

তাহলে সব মডেলই কি পরিপূর্ণ সঠিক পূর্বাভাস দিতে ভুল করে? বা দক্ষতা দেখাতে পারে না? কিংবা আংশিক সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অনেক আগেই বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ জর্জ বক্স। পরিসংখ্যানিক মডেল নিয়ে জর্জ বক্সের বিখ্যাত উক্তিটি ছিল–– সব মডেলই ভুল, কেবল কিছু দরকারি। চরম সত্য এই উক্তিটি মনে রেখে যেকোনও মডেলের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে মন্তব্য করা বাঞ্ছনীয়। এই ধরুন যশুয়া বুল নামে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথমেটিক্স ইনস্টিটিউটের একজন গবেষকের করা ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী ফাইনাল খেলবে ব্রাজিল এবং বেলজিয়াম, সেমিফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল, ফ্রান্স-বেলজিয়াম। প্রথম রাউন্ডের আগেই বেলজিয়ামের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় এই ফাইনাল এবং একটি সেমিফাইনাল এখন সম্ভব নয়।

এই মডেলের মাধ্যমে দ্বিতীয় রাউন্ডে ১৬টি উত্তীর্ণ টিমের মধ্যে সাতটি ভুলভাবে প্রেডিক্ট করা হয়েছিল, সঠিক প্রিডিকশন হার মাত্র ৫৬.৩ শতাংশ। কোনও একটি খেলায় দুইপক্ষ কতগুলো গোল করতে পারে তার পরিসংখ্যানের পয়সন প্রোপাবিলিটি ডিস্ট্রিবিউশন (Poisson Probability Distribution) ব্যবহার করে গোলের সংখ্যার সিমুলেশন করেছেন। এই সিমুলেশন মডেলে ৩২টি দলের ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব খেলার তথ্য ব্যবহার করা হয়। যেমন, গোলপোস্টে করা শর্টসের সংখ্যা, নিজ মাঠ-প্রতিপক্ষ মাঠের পারফরম্যান্স, পরস্পর শক্তির ব্যবধান ইলো রেটিং ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে। কোনও একটা টিমের প্রক্ষেপিত গোলপোস্টে করা শর্টসের সংখ্যা সংশোধন করা হয় ওপরের ওইসব ফ্যাক্টর দিয়ে।

যশুয়া বুল নিজেও টোয়েন্টি-টোয়েন্টি বিশ্ব ফ্যান্টাসি ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন হন ৮০ লাখ পার্টিসিপেন্টদের মধ্যে থেকে। নিজের দক্ষতা এবং অতি দক্ষ একটি পরিসংখ্যানিক মডেল ব্যবহার করার জন্য তার ভবিষ্যৎবাণী চাউর হতে দেখা গেছে। এই মডেলের কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যেমন দলের হঠাৎ বড় খেলোয়াড় ছিটকে পড়ে যাওয়ার ইফেক্ট, বিশ্বকাপের খেলার মাঠের দর্শকের উচ্ছ্বসিত সাপোর্ট কিংবা প্লেয়ারদের উজাড় করে দেওয়ার মনমানসিকতার  প্রভাব মডেলে নিয়ে না আসা।

আমিও ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই একটি মডেল প্রকাশ করি। আমার এই প্রেডিকশন মডেলের প্রথম রাউন্ড থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে সঠিক প্রেডিকশন হার ছিল ৬২.৫%। আমার মডেলটি পরিসংখ্যানিক কোনও মডেল না হলেও বেশি সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে বলেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের যশুয়া বুলের চেয়েও ভালো মডেল বলার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। যেহেতু এটি একটি নন-প্রবাবিলিস্টিক মডেল। এই মডেল অনুযায়ী ফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হবে। সেমিফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল, ফ্রান্স-জার্মানি। জার্মানি ছিটকে পড়ায় তার জায়গা নিতে পারে এখন সুইজারল্যান্ড, স্পেন বা পর্তুগাল।

ডাটা সায়েন্টিস্ট এবং মেশিন লার্নিং এক্সপার্টদের কেগল নামে একটি প্ল্যাটফর্ম আছে। এই প্ল্যাটফর্মে একটি মেশিন লার্নিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ১৮৭০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সব দলগত খেলার ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। যেখানে ফাইনাল খেলবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। তাতে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হবে। কেগল-এর ফাইনালের এই কম্বিনেশন এখন সম্ভব নয়। কেননা, ফাইনালের আগেই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নকআউট পর্বের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়ে যাবে।

ভিডিও গেম তৈরি করার বিখ্যাত কোম্পানি ইএ স্পোর্টস-এর সিমুলেশন মডেল মতে, এবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে আর্জেন্টিনা ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে। এর আগেও ২০১০ এবং ২০১৪-এর বিশ্বকাপে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছিল। স্কাই নিউজের মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করেও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে ব্রাজিলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এরপরে রয়েছে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্ভাবনা।

ইউরো স্পোর্টস নামক প্রতিষ্ঠান করা ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ফাইনাল খেলবে আর্জেন্টিনা ও সেনেগাল এবং আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হবে। এমন অন্য সব ভবিষ্যদ্বাণীর  প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে হয় আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিল।

নির্মল, নির্মোহ, অকুণ্ঠ, অকৃপণ, সীমাহীন আনন্দের উৎস হিসেবে ফুটবল খেলাকে বেছে নিয়েছে এরকম অগণিত খেলা প্রেমিক বা ভক্ত রয়েছে পৃথিবীর সর্বত্রই; যার অনেকেই মেসি, নেইমার, রোনালদো বা কিলিয়ান এমবাপের আবার অন্ধভক্ত অন্য দলের কঠোর সমর্থক হয়েও। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলার কৌশলগুলো প্রতিনিয়ত হাতের মুঠোয় চলে আসায় মুঠোফোনের কল্যাণে তা অগণিত ভক্ত সৃষ্টি করেছে দেশ-বিদেশে, শহর- উপশহরে, গ্রাম অজপাড়াগাঁয়ে, এমনকি নিভৃত পল্লিতেও।

বিশ্বকাপ এলে অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ভরে দিয়ে ফুটবল খেলাকে আপন করে নিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা খুঁজে পান সব ভক্তই যেখানেই বসে খেলা দেখুন না কেন। শত শত হাজার মাইল দূর থেকে হোক অথবা নিজ শহরে বসে। অন্য সব যে ভবিষ্যদ্বাণী থাকুক না কেন প্রিয় ভক্তের অন্তরে গাঁথা থাকে প্রিয় দলের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার ভবিষ্যদ্বাণী। বিশ্বকাপের শেষ দিনে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ বা স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে আবারও চার বছর পরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নের সূচনা ঘটে। সম্ভবত এজন্যই ফুটবল খেলা সব খেলার মধ্যে একাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অনিন্দ্য রাজা।

লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক