X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ভাষা পুলিশিং’: বাংলা একাডেমির অনুশীলন

আশফাক সফল
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:১৫আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:১৫

‘পুলিশিং’ শব্দটি এসেছে পুলিশ শব্দ থেকে আর ‘পুলিশ’ শব্দের সাথে সম্পর্কিত হলো ‘পলিসি’। সেই থেকে হিসাবে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ পুলিশিং’ বা ‘ভাষা পুলিশিং’ ভাষার ওপর নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কিছু একটা হওয়ার কথা। ‘ভাষা পুলিশিং’-এর তাত্ত্বিক লক্ষ্য ভাষার শুদ্ধতা নিশ্চিত করা। শুদ্ধ ভাষার অনুশীলন এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য ‘ভাষা পুলিশিং’ কাজ করবে অর্থগ্রাফি বা শব্দপ্রকরণ, ব্যাকরণ ইত্যাদি নিয়ে। যদিওবা  আমাদের দেশে ইদানিংকালে ‘ভাষা পুলিশিং’ কথাটা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের দেশে ‘ভাষা পুলিশিং’-এর ইতিহাস অনেকদিনের।

মূলত ষাটের দশকে ‘ভাষা পুলিশিং’-এর ধারণার শুরু। অনেক তাত্ত্বিক এটিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রভাব বলতে চান। ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার এই অভিযানে অনেকগুলো আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল ‘স্থিতিশীল ভাষা’-এর অবকাঠামো তৈরি। আরও গভীরভাবে বললে, সেই সময়ে ব্যাপক পরিসরে ব্যবহার করা ভাষাগুলোর একটা মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অনেকেই বলে থাকেন এটা ‘ডাইগ্লোসিয়া’র ধারণার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। ডাইগ্লোসিয়া ভাষার নির্দিষ্ট একটি মানকে ‘প্রমিত’ স্বীকৃতি দিয়ে অন্যান্য ডাইলেক্ট অথবা উপভাষা দূষিত বলতে চায়। প্রমিত ভাষার (বা ভাষার প্রমিত) চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির পতাকা দেখিয়ে কখনও কখনও সাহিত্যকে বেধে ফেলা হয় রীতিনীতির শৃঙ্খলে।

আবার অন্যদিকে বললে, উত্তর-ঔপনিবেশিক নয় ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমেই ভাষা পুলিশিং বিকাশ পেয়েছে। স্থানীয় ভাষাকে ঔপনিবেশিক শক্তিরা নিজেদের কাঠামোতে নিয়ে আসার জন্য বা নিজস্ব কাঠামোতে ব্যাখ্যা করার জন্য লিখিত ও ব্যাকরণগত দিকগুলোতে ব্যাপক পরিসরে মনোযোগ দেন; একই সাথে শব্দকোষ ও অভিধান তৈরি করেন। বিশ্বজুড়ে অন্যান্য অ-ঔপনিবেশিক ভাষার মতই বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ঔপনিবেশিকরা বাংলা ভাষাকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। ঘটনার শুরু পর্তুগিজ ধর্মযাজক মনোএল (Manoel da Assumpcam)-এর লেখা “Vocabolario em idioma Bengalla, e Potuguez dividido em duas partes” গ্রন্থটি লেখার মধ্য দিয়ে, যেখানে  অনেকটা লাতিন ভাষাতত্ত্বের মতো করে বাংলা ভাষাকে বিশ্লেষণ করা হয়। ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে বেশ কিছু গ্রন্থ লেখা হয়, যার বেশিরভাগ ছিল হয় ইংরেজিতে লেখা বা ইউরোপিয়ান ধারায় বর্ণনা করা। এমনকি উইলিয়াম কেরির ব্যাকরণও অনেকটা তাই। ফলশ্রুতিতে বাংলার বিশেষ করে বাংলার লিখিত রূপের কমবেশি সাধারণ আকার তৈরি হয়। যদিও সেটা সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি।

বাংলা একাডেমি

বাংলাদেশে বাংলার সর্বজন স্বীকৃত রূপ দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব বর্তায় বাঙালি সংস্কৃতির বাংলা একাডেমি’র ওপর। তাহলে বাংলা একাডেমিকে কি বাংলা ভাষার জন্য ‘ভাষা পুলিশ’ বলা যেতে পারে? যদি হয়েই থাকে তাহলে বাংলা একাডেমি কতটুকু নৈতিকতা মেনে ‘ভাষা পুলিশিং’ করছে? ঐতিহাসিক দিকে থেকে ভাষা পুলিশিংয়ের কাজ ব্যাকরণ, শব্দ ও তার প্রয়োগ নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে ‘ভাষা পুলিশিং’ প্রয়োগের ধরন নিয়ে দুনিয়াব্যাপী কিছু প্রশ্ন উঠেছে। অনেক ভাষা তাত্ত্বিক মনে করেন ভাষা পুলিশিংয়ের মাধ্যমে স্পর্শকাতর শব্দের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন, ‘অন্ধ’ শব্দের বদলে ‘দৃষ্টি প্রতিবন্ধী’ ব্যবহার করা।

আবার পুলিশিং বা পলিসি/নীতিমালা যদি লেখককে মালা হিসাবে না দিয়ে শৃঙ্খল হিসাবে পরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আরেকটি সমস্যা দানা বাঁধে। যেমন, কিছুদিন আগে ফাহাম আব্দুস সালামের একটা লেখায় মাধ্যমে জানতে পারলাম ‘তীর্থ’ শব্দের অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি অর্থ ‘যোনি’ (সূত্র: শেকায়েতনামা, ফাহাম আব্দুস সালাম, ২০১৪)। “তীর্থস্থান” শব্দের সাথে যদি “যোনি” শব্দকে মিলিয়ে ফেলে তাহলে  অর্থের একধরনের ভয়াবহতা তৈরি হলেও হতে পারে। কিন্তু মেয়েশিশু হিসাবে জন্ম নিয়ে ‘মেয়েবেলা’ পার করে একজন মানুষ হয়ে ওঠেন ‘নারী’। নারী পরিচয়ে আসতে  এবং আসার পরে কাউকে যে পরিমাণ শাসন আর শোষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা যদি কেউ নিজের “জন্ম ও যোনির ইতিহাস”-এ বলেন তবে সেটা কি মাত্রারিক্ত?

যখন ‘ভাষা পুলিশিং’-এর মাধ্যমে মত প্রকাশ বাধা পায় অথবা নির্দিষ্ট অর্থ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয় তখন বুনিয়াদি ও মতাদর্শিক সমস্যা তৈরি হয়। ২০১৬-১৭ সালে বই মেলায় বাংলা একাডেমি ‘শ্রাবণ প্রকাশনী’ নামের একটি প্রকাশনীকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। যদিও শর্ত সাপেক্ষে পরে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীতে ২০২৩ শালে আদর্শ প্রকাশনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই  রাজনৈতিক বা ধর্মীয় অনুভূতির পরিপন্থী  মতবাদ বা মন্তব্য প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়। যদিও প্রকাশনীদ্বয়ের বইগুলো আইনগত বৈধতা নিয়েই প্রকাশ ছিল বা বইগুলো আদালত বা সরকার কেউই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। কিছু বিশ্লেষক এটিকে ‘স্মার্ট সেন্সরশিপ’ হিসাবে দেখেছেন, যেখানে রাষ্ট্র নিজে সরাসরি কোন কিছুতে নিষিদ্ধ না করে কোনও রাষ্ট্রীয় সংস্থার সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। একই সাথে বাংলা একাডেমি প্রণীত “অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ নীতিমালা ও নিয়মাবলী”-অনুযায়ী  একাডেমি এবং মেলা আয়োজক কমিটি “বিশেষ কারণে” যেকোনও বই বা প্রকাশন প্রচার ও বিক্রি বন্ধের সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। এখানে ‘বিশেষ কারণ’-এর অপব্যবহারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন বেশ কিছু বিশ্লেষক। ‘বিশেষ কারণ’-এর ব্যাখ্যা আমজনতার কাছে না পৌঁছালেও; আশা করা যায় মহামান্য আদালতের কাছে সন্তোষজনক ‘ব্যাখ্যা’ পৌঁছে গেছে। ফলাফল, আদর্শ প্রকাশনীর আদর্শকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দের আদেশ স্থগিত হওয়া। যেহেতু বিষয়টি এখন আদালত প্রাঙ্গণে, আদালত ও আইনের  প্রতি সম্মানের জায়গা থেকেই আলোচনার ইতি টানছি।

শেষ দাগ

তবে প্রতিবছর পুরস্কার প্রদান আর বইমেলার আয়োজন ছাড়া বাংলা একাডেমির গত কয়েক দশকে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ চোখে পড়ে না (“ঈদ” বনাম “ইদ” বা “একাডেমী” বনাম “একাডেমি” তর্কে পাশে রাখছি আজকের মতো)। আর গত কয়েক বছরে বইমেলার যাকে ভালোবেসে আমরা বলি– “বাঙালির প্রাণের মেলা”, সেখানে বৈধ-অবৈধ, নিষিদ্ধ-বাতিলের মেলাও আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। তবে কি বাংলা একাডেমি “ভাষা পুলিশিং” এর দায়িত্ব নিয়ে মত প্রকাশের নীতিমালা তৈরিতে মনোনিবেশ করলো। তবুও আশা রাখি প্রগতিশীল ভাবনার চারণক্ষেত্রে প্রিয় বাংলা একাডেমি ফিরে আসুক বাঙালি সংস্কৃতি অভিভাবক হয়ে।

লেখক: আইটি প্রফেশনাল ও ব্লগার

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ