X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদে সংরক্ষিত আসন কি নারীর জন্য সম্মানজনক?

আমীন আল রশীদ
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০২আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২১:০২

বাংলাদেশের এককক্ষবিশিষ্ট আইন সভায় মোট সদস্যের সংখ্যা সাড়ে তিনশ’—যাদের মধ্যে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত; তারা সরাসরি জনগণের ভোটে নয়, বরং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মনোনয়নে পরোক্ষ ভোটে ‘নির্বাচিত’ হন।

সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে এই ৫০টি আসন বণ্টন করা হয়। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২২৪টি আসনে আওয়ামী লীগ, ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র, ১১টি আসনে জাতীয় পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয়লাভ করে।

প্রতি ৬ আসনের বিপরীতে একটি সংরক্ষিত আসন বণ্টন করা হয়। সে হিসেবে জাতীয় পার্টি পাবে দুটি। স্বতন্ত্র ৬২ জনের কোনও জোট হয়নি এবং তাদের কোনও নেতা নেই।

উপরন্তু স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ী প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং সংরক্ষিত আসনের বিষয়ে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ফলে এই ৬২ জনের বিপরীতে যে ১০ জন সংরক্ষিত এমপি দেওয়ার কথা, সেগুলোও পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। তার মানে সংরক্ষিত ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৮ জনই হচ্ছেন আওয়ামী লীগের।

সংরক্ষিত আসনে কারা মনোনয়ন পাবেন সেটি একান্তভাবেই দলের সিদ্ধান্ত। এখানে সাধারণ ভোটারদের কোনও অংশগ্রহণ নেই।

তবে এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। যেমন, জোটভিত্তিক ভোটের কারণে মনোনয়নবঞ্চিত দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা; দলের দুঃসময় ও আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা আছে; দলে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন কিন্তু মূল নির্বাচনে কোনও আসন থেকে বিশেষ কারণে মনোনয়ন পাননি; প্রয়াত এমপির স্ত্রী বা কন্যা; জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তির স্ত্রী বা কন্যা; সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, সমাজকর্মী এবং বিনোদন জগতের পরিচিতি মুখ তথা তারকা ইত্যাদি।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগ তাদের সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখে। এর বাইরে মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে এবং দলের জন্য ত্যাগ ও সাংগঠনিক দক্ষতার বিষয়গুলোও আওয়ামী লীগ বিবেচনায় নিয়ে থাকে।

যেহেতু এবার এককভাবে আওয়ামী লীগ ৪৮টি আসনেই নিজেদের প্রার্থী দিতে পারবে, ফলে এবার সংরক্ষিত এমপি হওয়ার জন্য দলের ভেতরে তো বটেই, দলের বাইরেও আগ্রহীর সংখ্যা প্রচুর। বিশেষ করে বিনোদন দুনিয়ার তারকাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছেন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য ১৫৪৯টি মনোনয়নপত্র বিক্রি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ বাবদ দলটির আয় হয়েছে সাত কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা (যুগান্তর, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)।

তারকাদের মধ্যে যারা সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের এমপি হতে চান তাদের মধ্যে অপু বিশ্বাস, নিপুণ আক্তার, শাহনূর, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, সোহানা সাবা, মেহের আফরোজ শাওন, তানভীন সুইটি, জাকিয়া মুন প্রমুখের নাম গণমাধ্যমে এসেছে।

এর বাইরে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় নেতা এবং তার বাইরে অনেক নারী এবার সংরক্ষিত আসনের এমপি হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে জাতীয় পার্টির দুটি আসনে যে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদের এবং দলের কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম মনোনয়ন পাচ্ছেন, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। এই দুজনই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হেরে গেছেন।

সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের যারা মনোনয়ন পাবেন তাদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য তিনটি আসন বরাদ্দ রয়েছে। এই তিনটি আসনের বিপরীতে আলোচনায় আছেন চট্টগ্রামের অন্তত ১৬ জন নারী।

শেষ পর্যন্ত সংসদের সংরক্ষিত ৫০টি আসনের মধ্যে কোন ৪৮ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন, সেটি শিগগিরই জানা যাবে। তবে প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। সেটি হলো, যখন দেশের রাজনীতি-প্রশাসনসহ সর্বত্রই নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এবং জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়ে আসছেন—সেখানে এখনও ৫০টি আসন শুধু নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা এবং জনগণের অংশগ্রহণের বাইরে দলীয় প্রধানের পছন্দ-অপছন্দের ওপরে বিষয়টি নির্ভরশীল রাখা কতটা যৌক্তিক?

প্রসঙ্গত, আইন প্রণয়নে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংবিধানে সংরক্ষিত নারী আসন চালু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সালে। কিন্তু সংরক্ষিত আসনের এমপিদের কাজ ও এখতিয়ার, প্রয়োজনীয়তা, নারী উন্নয়নে সংরক্ষিত আসনগুলো আসলেই কতটা ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়েই বিতর্ক হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। বিশেষ করে নবম সংসদে প্রধান দুটি দলের সংরক্ষিত আসনের বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের আচরণ ও কথাবার্তায় এই পদটি যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। অনেক সময় এমন কথাও উঠেছে যে সংরক্ষিত আসনগুলো আসলে আলংকারিক।

প্রশ্ন হলো, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন কেন থাকতে হবে? নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ, তাই তাদের জন্য সংসদের সংরক্ষিত আসন থাকা উচিত, এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। যেমন, সমাজ ও রাষ্ট্রের আরও যেসব পিছিয়ে পড়া অংশ, যেমন আদিবাসী (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী), ধর্মীয় সংখ্যালঘু, শারীরিক প্রতিবন্ধী, দলিত- তাদের জন্য সংসদে আসন কেন সংরক্ষিত থাকবে না?

সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যরা কোনও নির্বাচনি এলাকা থেকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন না। তারপরও তাদের সাংবিধানিক মর্যাদা সরাসরি নির্বাচিত এমপিদের মতোই। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের মতোই তারা বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন। বিল পাস ও সংসদের অন্যান্য প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। এমনকি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও হতে পারেন। তাদের বেতন-ভাতা-সম্মানি এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার সুযোগও সরাসরি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে সংরক্ষিত আসনের এমপিদের খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কারণ তাদের নির্দিষ্ট কোনও নির্বাচনি এলাকা নেই। কোনও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও সেই এলাকায় যেহেতু সরাসরি নির্বাচিত এমপি রয়েছেন, ফলে ভোটার ও অন্যান্য মানুষের কাছে সংরক্ষিত আসনের এমপিরা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হন। বড় কোনও সমস্যার সমাধান বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনের এমপিদের বিবেচনা করা হয় না।

প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত এই ৫০ জন নারী সাংবিধানিকভাবে আইনপ্রণেতা, কিন্তু তারপরও শাসনকাজে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। একজন নারী সদস্যকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গত ৫ বছরে আপনি কী কী করেছেন, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা রেখেছেন, তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনও জবাব আসবে বলে মনে হয় না।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা—এমন কথা বলা হলেও বাস্তবতা হলো এর দ্বারা লাভবান হয় মূলত দল। অর্থাৎ ৩০০ আসনে জয়ের আনুপাতিক হারে দলগুলো যেহেতু সংরক্ষিত আসন পায়, ফলে জাতীয় নির্বাচনে যে দল সবচেয়ে বেশি আসন পায়, তারাই আবার আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি সংরক্ষিত আসনের মালিক হয়। এটা অনেকটা ক্ষমতাবানকে আরও ক্ষমতায়িত করার একটা কায়দা।

সংরক্ষিত আসনে কারা মনোনয়ন পাবেন, কী তাদের যোগ্যতা—সে বিষয়ে দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সব মিলিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সংরক্ষিত আসনের কথা বলা হলেও আদতে এর দ্বারা নারীর ক্ষমতায়ন কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে বা হচ্ছে সেই তর্কের অবসান হয়নি।

তাহলে সমাধান কী? সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা বাতিল করে এর বিকল্প হিসেবে সংসদের মূল আসন সংখ্যা ৩০০-এর সঙ্গে সংরক্ষিত ৫০টিকে বিভিন্ন জেলায় ভাগ করে সব দল যদি কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী দিতে বাধ্য হয়, তখন দেখা যাবে সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়বে এবং সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসার ফলে তাদের মর্যাদা ও গুরুত্বও বাড়বে। কোন কোন আসনগুলো নারীদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে, সেটি দলের নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নেবেন। কিছু আসনে হয়তো জটিলতা সৃষ্টি হবে, বিশেষ করে যেখানে দলের পুরুষ প্রার্থী অনেক বেশি ক্ষমতাবান, সেখানে তুলনামূলক কম ক্ষমতাবান নারীকে প্রার্থী করলে দলীয় কোন্দল বেড়ে যাওয়া কিংবা ওই নারী প্রার্থীর হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কিন্তু এটি নারীদের ব্যাপারে আমাদের সামগ্রিক রাজনীতির যে বিবেচনা ও দৃষ্টিভঙ্গি, সেটিও পরিবর্তন করা দরকার। নারী মানেই তাঁর জন্য বিশেষ সুবিধা রাখতে হবে, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসারও সময় হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষিত নারী কারও করুণা চায় বলেও মনে হয় না।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ