X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতে নির্দেশনা জারি জরুরি

আমীন আল রশীদ
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৪:৩৬আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৬:৫২

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ‘স্বৈরাচার’ বললেও তিনিই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য ১৯৮৭ সালে একটি আইন করেছিলেন—যার নাম ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’। এই আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।

দেশের সরকারি অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের পরিমাণ ও প্রবণতা বাড়লেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা যে নানাভাবেই অবহেলার শিকার হচ্ছে—সেটি দৃশ্যমান। উচ্চশিক্ষার স্তরে এখন ইংরেজি ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষার উত্তরও ইংরেজিতে লিখতে হয়। অথচ বাংলা ভাষার জন্য এই দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার মেডিক্যাল শিক্ষায়। সেখানে সব পড়াশোনা হয় ইংরেজিতে। বলা হয়, বাংলায় মেডিক্যাল ও বিজ্ঞানের বই নেই। কেন নেই? একসময় বাংলায় লিখিত মেডিক্যালের বই পড়েই এই উপমহাদেশে অনেক প্রখ্যাত ডাক্তারের জন্ম হয়েছে। এখন বাংলায় মেডিক্যালের বই নেই কেন? ভালো অনুবাদক নেই নাকি ইংরেজি বই সহজলভ্য বলে? নাকি এর পেছনে কোনও দুরভিসন্ধি আছে? বাংলায় বিশ্বসাহিত্যের সব বই অনূদিত হতে পারলে মেডিক্যালের বই কেন হবে না? বাংলা যে দেশের রাষ্ট্রভাষা, সেই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজিকে কেন প্রাধান্য দেওয়া হবে?

শিক্ষা ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অথচ দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজগুলো সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে। রাষ্ট্র কি এদের স্পর্শ করতে ভয় পায়? নাকি এখানে সমাজের উঁচুতলার মানুষদের সন্তানরা পড়েন বলে এখানে হাত দেওয়া যাবে না?

বাংলা ভাষার জন্য যে দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, সেই দেশে বাংলা বলা ও লেখায় কেন এই উন্নাসিকতা আর ইংরেজির মতো এটি বিদেশি ভাষার প্রতি কেন এত প্রেম? সবাই কি বিদেশে গবেষণা বা চাকরির জন্য যাবেন? চাকরি বা যোগাযোগের জন্য যে পরিমাণ ইংরেজি জানার প্রয়োজন, ছয় মাসের কোর্স করেই সেই দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু শৈশব থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত কেন ইংরেজিতে পড়াতে হবে? এটি কি নিজেদের আর্থিক ও সামাজিক স্তরবিন্যাস বোঝানোর একটি হাতিয়ার? রাষ্ট্র কেন শিক্ষা খাতে এই ধরনের নৈরাজ্য ও বৈষম্য জিইয়ে রাখবে?

এই অভিযোগ বেশ পুরনো যে বাংলা সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয় আদালতে। বিশেষ করে উচ্চ আদালতে। কেননা সেখানে খুব ব্যতিক্রম ছাড়া ইংরেজিতে রায় লেখা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও রায় যখন ইংরেজিতে লিখিত হয়, সেটি মামলার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কাছে কোনও অর্থ বহন করে না। ফলে রায় ও আদেশ নিয়ে আইনজীবী তাদের যা বোঝান, তারা সেটুকুই বোঝেন।

তবে উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখার প্রবণতা শুরু হয়েছে। এ বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের সম্মানে বাংলায় রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলায় আদেশ দেন। শুনানির শুরুতে হাইকোর্ট বলেন, ‘আজ ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন। আজ আমরা বাংলায় দেবো সব আদেশ।’ এরপর একের পর এক আদেশ ও রায় বাংলায় দেন হাইকোর্টের এই বেঞ্চ।

এর আগে গত বছরের একই দিনে, অর্থাৎ পয়লা ফেব্রুয়ারি এক রিট মামলায় বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চও বাংলায় রায় ঘোষণা করেন। পাশাপাশি গত বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটের ‘বাংলা সংস্করণ’ উদ্বোধন করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট বিভাগে যোগদানের পরে এখন পর্যন্ত বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সবচেয়ে বেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। আর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে মামলায় ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতি যে রায় দেন, সেখানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বাংলায় রায় লেখেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন। তার মানে পরিবর্তন হচ্ছে। তবে আরও অনেক পথ যেতে হবে।

মূল চ্যালেঞ্জ হলো দেশের অধিকাংশ আইন এখনও ইংরেজিতে। আবার অধিকাংশ আইন ব্রিটিশ আমল থেকেই চলছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ব্রিটিশ আমলের আইনগুলোর বদলে যে বাংলাদেশের উপযোগী করে বাংলায় আইন করতে হবে, সেই ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে খুব কম। এখন যেসব আইন হচ্ছে, সেগুলোর ভাষা বাংলা। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার মূল আইনগুলোর বিরাট অংশই এখনও ইংরেজিতে। 

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। তার মানে রাষ্ট্রের সর্বত্র (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) বাংলা ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত এবং সেটি না করা অসাংবিধানিক। আর সংবিধানের এই বিধানের আলোকেই ১৯৮৭ সালে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন আইন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই আইন যে পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না, তার বড় উদাহরণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

বাংলা ভাষার প্রতি যেসব প্রতিষ্ঠান অবহেলা বা উন্নাসিকতার পরিচয় দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান ও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কোনও প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত বা নীতিমালা যদি বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করে, শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচিত হবে প্রথমে তাদের সতর্ক করা। এরপরও তারা তাদের নীতি ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। কেননা, যে দেশটি স্বাধীন হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরে, সেই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাংলা অবহেলিত হবে, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। 

বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় নির্ণীত হয় দু’ভাবে। প্রথমত ভাষা এবং দ্বিতীয়ত নদী। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বিরল জাতির নাম বাঙালি। আর পৃথিবীর একমাত্র নদীমাতৃক দেশের নাম বাংলাদেশ। অথচ সেই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা নিদারুণ অবহেলার শিকার। সেই নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোই আজ বিপন্ন। যে নদী এই দেশের মানুষের জীবনরেখা, সেই দেশের মানুষেরাই কথিত উন্নয়নের নামে নদীর গলা টিপে হত্যা করে। খননের নামে বড় নদীকে খাল আর ছোট নদীকে ড্রেনে পরিণত করে।

একইভাবে ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া জাতির মানুষেরাই নিজের ভাষায় একটি একটি অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়। ইন্টারনেট বা অভিধানের সহায়তা ছাড়া ছোটখাটো বানানও সঠিকভাবে লিখতে পারে না। কারণ বাংলা যে শুদ্ধভাবে লিখতে ও বলতে পারতে হবে, না পারলে এটি যে বিরাট অযোগ্যতা—সেই বোধটুকু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সে পায়নি। বরং তাকে বোঝানো হয়েছে ইংরেজি জানতে হবে। কারণ ইংরেজি জানলে তার চাকরি পাওয়া সহজ হবে। অর্থাৎ কেউই এখন আর শিক্ষার্থী হতে চায় না। সবাই পরীক্ষার্থী। সবাই চাকরিপ্রার্থী। সবাই চাকর হতে চায়। নিজের ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে তার চাকর হওয়ার পথ মসৃণ করা কঠিন। ফলে তার কাছে বিদেশি ভাষার গুরুত্ব বেশি।

বস্তুত আমাদের শিক্ষার মাধ্যম বহুবিভক্ত এবং চরম বৈষম্যপূর্ণ বলে ভালো ইংরেজি জানা লোকের চাকরির বাজার বড়। ফলে ভালো বাংলা জানা লোক যত মেধাবীই হোক, ইংরেজি জানা লোকের সঙ্গে সে প্রতিযোগিতায় টেকে না। এ জন্য অর্থনীতির বিশ্বায়নকে দায়ী করা হলেও, এটি স্পষ্টতই বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে এখন যে সংকটের মধ্যে আমরা রয়েছি, এই সংকট ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৌখিক ও লিখিত নির্দেশ সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিল্প, বাণিজ্য ও সরকারি কাজকর্মের সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলন যথাযথভাবে প্রচলিত না হওয়ায় তিনি ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ স্বাক্ষরিত পত্রে অত্যন্ত কড়া ভাষায় একটি নির্দেশনা জারি করেন। সেটি এরকম: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটি অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা সরকারি অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোনও অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস- আদালতের কর্তাব্যক্তিগণ সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকর করবেন এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা করবেন। তবে বিদেশি সংস্থা বা সরকারের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করার সময় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষায় একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন। তেমনিভাবে বিদেশের কোন সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সময়ও বাংলার পাশাপাশি অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলবে।’

সেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাঁকেও এখন এরকম একটি নির্দেশনা জারি করতে হবে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ