X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

করোনাকালে ডাক্তার আর আমলাদের আচরণ

আনিস আলমগীর
৩১ মার্চ ২০২০, ১৩:২০আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২০, ১৭:৪৪

আনিস আলমগীর গত ২৭ মার্চ, শুক্রবার বিকালে মাস্ক না পরে বাজারে যাওয়ায় তিন খেটে খাওয়া বয়স্ক ব্যক্তিকে কান ধরিয়ে লাঞ্ছিত করেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার এসি ল্যান্ড সায়মা হাসান। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। সরকারের এসি ল্যান্ডদের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে বিরক্ত ছিলাম। মণিরামপুরের এসি ল্যান্ড সম্পর্কে আমার রাগ হওয়ার কারণ শুধু তিনজন নিরীহ বৃদ্ধ মানুষকে কানে ধরানো নিয়ে না, সেটা নিজের অফিসিয়াল পেজে কাভার ছবি করেছেন বলে। এক বন্ধু একই ক্ষোভে একটা পোস্ট দিলে সেখানে মন্তব্য করি। কিন্তু ফেসবুকের ভাইরাল পোস্টগুলোতে ওই নারী কর্মকর্তাকে নোংরা আক্রমণ দেখে আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে নিজের মন্তব্য ডিলিট করার চিন্তা করছিলাম, যেখানে আমি বলেছিলাম ডিসিদের থেকে আশকারা পেয়ে এসি ল্যান্ড কর্মকর্তাদের স্পর্ধা বেড়ে যায়। পোস্টটা আমি খুঁজে পেলাম না। সারাদিন আমি অনেক ভিডিও পেলাম এই নিয়ে। বিশেষ করে আমলাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও মিক্স করে বানানো ভিডিওটা প্রায় সবাই দেখেছেন মনে হয়।

তার পরদিন দেখলাম, মণিরামপুরের ইউএনও লাঞ্ছিত ব্যক্তিদের বাড়িতে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যান। দুঃখ প্রকাশ করেন। তাদের হাত ধরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষমা চান। সার্বিক সহযোগিতাসহ ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এসি ল্যান্ডকেও সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর আর বলার কী থাকে! খোঁজ নিয়ে জানলাম, মাত্র বছর দুই হয়েছে এই নারী কর্মকর্তা চাকরিতে ঢুকেছেন। ছবিটি তার টেকনিক্যাল সহকারী তুলেছে। এখানে কোনও কূটচাল ছিল না, বেচারি পরিশ্রম করছেন, যাতে জনগণ সরকারি নির্দেশ মানে সেই সরল মনে। কিন্তু ভাব নিতে গিয়ে গলদ হলো। আবার ভুল মানুষের হতেই পারে। বয়স আর অভিজ্ঞতা বাড়লে হয়তো এটা করতেন না তিনি।

আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ারও কোনও চরিত্র নেই। ট্রেন্ড বা স্রোত কখন কোন দিকে যাবে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। যে লোকগুলো মেয়েটিকে অকথ্য গালি দিয়েছে এদের অনেকেই কিন্তু ভারত-পাকিস্তানে করোনা লকডাউনে পুলিশের অ্যাকশনের ভিডিও ভাইরাল করে উৎসাহ জমিয়েছে, দরিদ্র মানুষদের পথেঘাটে নাজেহাল করার জন্য। আবার আমরা এমন যে বিশেষ কোনও বাহিনী নামলে রাস্তায় থাকি না, আবার আরেক বাহিনী নামলে আইনের তোয়াক্কা করি না। বিনা লাঠির সরকারি কর্মকর্তাদের তো পাত্তা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অথচ মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তারা যদি কঠোরতা না দেখান, প্রশাসন ভেঙে পড়বে। নতুন এক অরাজকতা কাজ করবে তখন।

প্রশাসন ক্যাডারের ভেতরের খবর অনেক জানি। তার দুর্নীতি, ভুল আর অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে লেখার এবং সমালোচনা করার অনেক সময় পড়ে আছে। এখন দেশ আর বিশ্ব পড়েছে মহাসংকটে। সরকার বা আমাদের কারোই মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া দেশের স্বার্থে উচিত হবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ইচ্ছা তা বলার এখন সময় নয়। আমাদের আরও ভাবতে হবে মাঠপর্যায়ে প্রায় নয়শ’ নবীন কর্মকর্তা ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডের মতো পোস্টে আছেন, তাদের মধ্যে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ জন নারী। এসব নারীকে কটাক্ষ করা সোসাইটিতে, দেশে, ব্যুরোক্রেসিতে আরেকটা ক্রাইসিস দেখা দেবে। এর নেতিবাচক দিকটা ভাবার ক্ষমতা সোশ্যাল মিডিয়ার নেই।

তবে করোনাকালে একটি কথা না বললেই নয়, সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা অভিমানী ভূমিকা পালন করছেন। তারা মানবতার সেবায় এই সময়ে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, সেভাবে পড়ছেন না। অনেক হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সেবা দেওয়া হচ্ছে না বলে হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরে রোগী মারা যাচ্ছেন। ডাক্তাররা করোনা সন্দেহে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছেন অন্য রোগীদেরও। পুরো ডাক্তার সমাজ না হলেও সিংহভাগ করোনাভাইরাসের আতঙ্কে পড়েছেন। এ আচরণ তাদের পেশার সঙ্গে মানায় না। নন্দলালের জীবন তাদের না।

এর জন্য কি শুধু ডাক্তাররা এককভাবে দায়ী? সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ডাক্তারদের পিপিই (পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এমন বহু ছবি ভাইরাল হয়েছে। অথচ অনেক হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবীরা পিপিই পাচ্ছেন না, পোস্ট দেখছি। নিম্নমানের এবং রেইনকোটের কাপড় দিয়ে বানানো পিপিই পাঠানো হয়েছে বলে তারা ফেরত দিয়েছেন, এমন খবরও এসেছে। ব্যাংকের ম্যানেজার, ব্যাংকের দারোয়ান আর সাধারণ স্টাফরা পরে আছে পিপিই, যা শুধু আমাদের বাজারে নয় সারা বিশ্বের বাজারে এখন সংকট চলছে। টাকা থাকলেই কি মানুষ সবকিছু কিনতে পারবে! এগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দেখার দায়িত্ব কার?

একজন মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেয়ে ডাক্তার-নার্স, হাসপাতালের অন্যান্য হেল্পিংহ্যান্ডদের পিপিই জরুরি এখন। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাত আর মুখ ঢাকার সামগ্রীই তো যথেষ্ট। তারা কি বিদেশ ফেরত বাংলাদেশির বাড়িতে প্রবাসীর শরীর নাড়াছাড়া করবেন? পথে চলা বেয়াড়া মানুষদের ঘরে ঢুকাতে তাদের গায়ে হাত দেবেন? পিপিই তাদের লাগবে কেন! অন্যকে নিবিড় স্পর্শ করার কাজ তো ডাক্তার করবেন, সে কারণে পিপিই এখন ডাক্তার পরবেন।

কিন্তু ডাক্তাররা পিপিই পাচ্ছেন না, এটিই বা কতটুকু সহি সত্য? তাদের জন্য ১ লাখ ৮০ হাজার পিপিই পাঠানো হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন বলছেন, ডাক্তারদের পিপিই তারা ব্যবহার করছেন না। এগুলো প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ অন্য উৎস থেকে পাওয়া। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম ডাক্তারদের পিপিই থেকে প্রশাসনের মাঠের প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তা আড়াই হাজার পিপিই ‘মেরে দিয়েছেন’। আরও ধরে নিলাম এসব কর্মকর্তা তাদের পরিবারের বউ, ছেলেমেয়েদের জন্য আরও তিনটি করে রেখে দিয়েছেন। তাহলেও তো আরও ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে যায়। সেসব কোথায় গেলো! স্বাস্থ্যসেবকরা পাননি! আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কীভাবে নিশ্চিত হয়েছে স্বাস্থ্যসেবকরা তাদের জন্য পাঠানো পিপিই প্রয়োজনীয়তা অনুসারে পেয়েছেন? সেগুলো যথাযথ মানসম্পন্ন। কোনও অভিযোগ নেই ডাক্তারদের।

সোশ্যাল মিডিয়া আসায় হারিয়ে যাচ্ছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া। আমরা আমাদের যুক্তিতে, বুদ্ধিতে তালা লাগিয়ে দিয়েছি। সবকিছুকে হাস্যকর করে তুলছি। না জেনে আক্রমণ করছি এই মিডিয়ায়। সুযোগ বুঝে ডাক্তার সাহেবরাও অভিমানের পর অভিমানে আছেন, ভাবছেন না যে রোগীরা তাদের আল্লাহর পরে স্থান দিয়ে রেখেছেন। এখন তো আরও বেশি মাত্রায়। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে রোগীদের ফেরত পাঠানোর পেছনে এই পিপিই একমাত্র কারণ আমি মানতে রাজি না।  হাসপাতালগুলোতে পিপিই নতুন ব্যবহার হয়ে আসছে না। এটা শুধু করোনাভাইরাসের জন্য আবিষ্কৃত হয়নি।  করোনাই একমাত্র প্রাণঘাতী ভাইরাস না। এই বিশ্বমহামারিকালে বাংলাদেশি ডাক্তারদের সেবার সদিচ্ছা আছে কিনা সেটাই এখানে প্রধান বিষয়।

এই ডাক্তাররা আমাদের জটিল সংকটের সময়ে দেবদূত হয়ে এসেছেন বহুবার। আবার ক্রাইসিস মুহূর্তেই আরও ক্রাইসিস তৈরি করেছেন এমন দু’চার ঘটনাও আছে। এখনও সে রকম একটি মান-অভিমান আর ভীতির কাল চলছে বলে আমার বিশ্বাস। বেশিরভাগ ডাক্তার সরকারি চাকরি করেন কিন্তু মানতে চান না প্রশাসনিক কর্তৃত্ব, চলতে চান নিজেদের ইচ্ছামতো। আর প্রশাসন ক্যাডার দ্বারা কল্পিত নিষ্পেষণের প্রচার করে মানসিক কষ্টে ভোগেন। সে কারণেই মনে হয় ডাক্তারির মতো একটি পেশাদারি পড়াশোনা শেষ করে তাদের অনেকে বিসিএস দিয়ে প্রশাসন-ফরেন সার্ভিস ক্যাডারে চলে যান।

করোনার কাজে দেশে কোথাও তো কোনও সমন্বয় দেখছি না। এখনও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো একসঙ্গে করণীয় কাজ নিয়ে বসছেন দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলছেন কষ্ট করে হলেও সবকিছু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ থাক। আবার পুলিশ বলছে, হোটেল খুলতে পারবেন, আড্ডা দিতে পারবেন না। সব তামাশা।

প্রধানমন্ত্রী ৩০ মার্চ রাতে ছয় মন্ত্রীকে ডেকেছেন দেখলাম। এখন ফলোআপ দেখার অপেক্ষায়।

ওদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এলোমেলো কথাবার্তা থামছেই না। তিনি একটি মন্ত্রণালয় চালান আর ডাক্তারদের পিপিইকে বারবার বলছেন পিপিপি। ভেন্টিলেটরের সমস্যা সারা বিশ্বে, তিনি সেটার সংকট দেখছেন না। আশ্বাসের পর আশ্বাস দিচ্ছেন, কিন্তু মানুষ ক্রমেই মনোবল হারিয়ে ফেলছেন তার কথায়। করোনা আক্রান্ত মহামারির দেশগুলোতে শুরুতে দু’চারজন মরছে। মহামারি দেখা দিয়েছে মাসখানেক পর। আমরা সেই সময় এখনও পার করিনি। সত্যি সত্যি দেশে যদি করোনার মহামারি শুরু হয় এই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য অবকাঠামো আর স্বাস্থ্য সেক্টরের দুর্নীতিবাজ, অকর্মণ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে দেশটা কোন দিকে যাবে, কেউ জানি না। প্রায় তিনটি মাস হেলায় কাটিয়েছে, কিন্তু করোনা প্রতিরোধের কোনও ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যসেবা সচিব। অবাধ রেখেছে বিমানবন্দর। অন্য কোনও দেশে হলে তো এ ঘটনায় দায়িত্বশীলরা পদত্যাগ করতো।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক