X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে-বিদেশে পিএইচডি: জানা অজানা প্রসঙ্গ

ড. মো. রাশেদ হোসাইন
২৪ আগস্ট ২০২০, ১৬:০৪আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২০, ১৬:১১

ড. মো. রাশেদ হোসাইন প্রাণনাশকারী কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস চীনের উহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এসে পৃথিবীব্যাপী ভয়ঙ্কররূপে ছড়িয়ে পড়ায় সারা বিশ্বে এ বিষয়ে গবেষণার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আগামী ১০-১৫ বছরে করোনাকে কেন্দ্র করে কয়েকশ’ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জিত হবে, তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। অর্থাৎ প্রকৃতি তার চিরায়ত নিয়মে নতুন নতুন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটিয়ে গবেষণার দ্বার উন্মোচিত করে চলেছে। সভ্যতার বিকাশে নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ করা খুবই অপরিহার্য। আর নতুন জ্ঞান খুঁজতে হলে গবেষণার কোনও বিকল্প নেই। ইংরেজি Research-এর বাংলা প্রতিশব্দ গবেষণা করা বা অনুসন্ধান করা। গবেষণা একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া যা (১) তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের সঙ্গে সম্পৃক্ত, (২) অধ্যয়ন বিষয়ক কিছু নিয়মকানুন দ্বারা উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সেই তথ্য উপাত্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা এবং (৩) নির্বাচিত কিন্তু সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়ে একটি দলিল রচনা করা।
কোনও একটি বিষয়ে নতুন জ্ঞান অনুসন্ধান গবেষণার মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হলেও সেসব জ্ঞান একত্রিত করে মুদ্রিত আকারে দৃশ্যমান করাও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। গবেষণার রকমফের থাকলেও পিএইচডি বা Doctor of Philosophy এক ধরনের গবেষণা যা একাডেমিক সর্বোচ্চ ডিগ্রি হিসেবেও পরিচিত। পিএইচডি একটি অর্জিত গবেষণামূলক ডিগ্রি যা একজন প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মৌলিক কাজের জন্য দেওয়া হয়। আবার প্রখ্যাত জার্নালে প্রকাশিত কিছু গবেষণামূলক আর্টিকেলের ওপর ভিত্তি করেও পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়। ইংরেজিতে পিএইচডিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়—PhD is an earned research degree awarded to a doctoral candidate who has done extensive and original work into a particular subject. Doctor of Philosophy কে সংক্ষেপে পিএইচডি (PhD, Ph.D., D.Phil) বলা হয়ে থাকে, যা স্নাতক পরবর্তী ডিগ্রি (Post Grad Programme) হিসেবেও অধিক পরিচিত। এটি দেশে-বিদেশে কোনও স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রদত্ত হয়। পিএইচডি অর্জনের জন্য একজন গবেষকের গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারণ করাসহ কাজের মান সম্পর্কে সচেতন থেকে নতুন জ্ঞান তৈরির অদম্য ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা থাকতে হয়। দেশভেদে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বা ৫ বছর এক বা একাধিক তত্ত্বাবধায়কের অধীনে কোনও একটি সুনির্দিষ্টি বিষয়ে তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে মৌলিক কাজ করে একটি অভিসন্দর্ভ (Dissertation) প্রস্তুত করতে হয়। একজন পিএইচডি প্রার্থীকে কোর্স ওয়ার্ক (Course work), বুদ্ধিগম্য পরীক্ষা (Comprehensive Exam), অভিসন্দর্ভ জমা প্রদান (Submission of Dissertation) সহ সর্বশেষ মৌখিক পরীক্ষা (Defense) ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অভিসন্দর্ভ হলো গবেষণাকর্মের দৃশ্যমান দলিল, যা একজন পিএইচডি গবেষক গবেষণা শেষে প্রিন্ট করে বাঁধিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দাখিল করেন। স্নাতক সম্পন্ন করেও পিএইচডি করা যায়, সেক্ষেত্রে আমেরিকা,চীন এবং ইউরোপের কিছু দেশে কমপক্ষে ৫ বছর সময় লাগতে পারে। পিএইচডিকে কোনও কোনও দেশে পূর্ণকালীন চাকরি আবার কোনও দেশে বৃত্তি বাবদ গবেষণাকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

 

বর্তমান পিএইচডি ডিগ্রির ইতিহাস খুব বেশি দিনের না হলেও তার অল্প বিস্তর বিবর্তনমূলক অতীত রয়েছে। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে প্রথম ইউরোপে অভিসন্দর্ভ জমার ভিত্তিতে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রির উন্নয়ন ঘটে। Keith Allan Noble (১৯৯৪)-এর মতে সর্বপ্রথম ১১৫০ সালে মধ্য প্যারিসে ডক্টরাল ডিগ্রি প্রদান করা হয়। মূলত শিক্ষকদের অধ্যয়নের অনুমতি হিসেবে এই ডিগ্রি দেওয়া হতো। সেসময় এখনকার মতো অভিসন্দর্ভ জমা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এরপর ১৬৫২ সালে প্রথম জার্মান হিসেবে Erhard Weigel পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৬১ সালে সর্বপ্রথম মোট ৩ জনকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করেন, যারা হলেন Eugene Schuyler, Arthur Williams Wright Ges James Morris Whiton (রোজেনবার্গ, ১৯৬১)। তার আগে আমেরিকানরা মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পিএইচডি করতে যেতেন। ১৮৬০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৮৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টর অব সায়েন্স (ডিএসসি) ডিগ্রি প্রবর্তন করলেও যুক্তরাজ্যসহ বিদেশি ছাত্রদের কাছে অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রি ১৯১৭ সালে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে (সিম্পসন, ১৯৮৩)। অন্যদিকে ১৮০৮ সালে জার্মানিতে, রাশিয়ায় ১৮১৯ সালে এবং ১৯২৭ সালে ইতালিতে পিএইচডি ডিগ্রির যাত্রা শুরু হয়।  

Doctor of Philosophy কে ল্যাটিন ভাষায় Philosophiae Doctor বা Doctor Philosophiae বলা হয়। বাংলায় এর কোনও পারিভাষিক শব্দ না থাকলেও সংক্ষেপে পিএইচডি বলা হয়ে থাকে। যেকোনও বিষয়েই পিএইচডি গবেষণা করা যায়। তবে বিষয় ভেদে কাজের ধরন ও পদ্ধতিতে ভিন্নতা থাকতে পারে। যেমন, কোভিড-১৯ বিষয়ে একজন আইনের ছাত্রের পিএইচডি গবেষণা একজন অণুজীব বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান কিংবা ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রের পিএইচডি গবেষণা এক হবে না। তবে তাদের প্রত্যেকের ডিগ্রিকেই Doctor of Philosophy বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের মনে মাঝে মধ্যেই  প্রশ্ন জাগে, কেউ দর্শন বা Philosophy বিষয়ে পড়াশোনা না করে কিংবা দর্শন বিষয়ে গবেষণা না করেও কেন সব বিষয়ের প্রদত্ত ডিগ্রিকেই Doctor of Philosophy বলা হয়ে থাকে? আসলে দর্শন বা Philosophy’র ধারণা একটি গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা অত্যন্ত বিস্তৃত। ইংরেজি Philosophy শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘দর্শন’ হলেও এটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ Philosophia থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার আক্ষরিক অর্থ Love of Wisdom বা জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, যে জ্ঞান বিশ্বজগৎ ও মানব জীবন বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। প্রাচীনকালে জ্ঞানের মূল ভান্ডারই ছিল এই দর্শন।

মূলত দর্শন এই জগৎ, জীবন, অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, কারণ, মানব মন, ভাষা প্রভৃতি বিষয়ের সাধারণ ও মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে অধ্যয়ন করে। ঐতিহাসিকভাবে ধর্মতত্ত্ব, আইন ও চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়া অন্যান্য বিষয় যেমন— ইতিহাস, দর্শন, সমাজনীতি, অর্থনীতি, গণিত, পদার্থ, প্রকৃতি, উদার শিল্প, যুক্তি, চেতনা প্রভৃতি একসময় দর্শন শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই বলা যেতে পারে পিএইচডি গবেষণায় এমন কোনও বিষয় নেই যা এই বিশ্বজগৎ বা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে না। একারণেই মূলত দর্শন ছাড়াও অন্য যেকোনও বিষয়ের ডিগ্রিকে Doctor of Philosophy বলা হয়।  

বিশ্বে কয়েক প্রকার ডক্টরাল ডিগ্রি দেখা গেলেও সব ডক্টরাল ডিগ্রিই কিন্তু পিএইচডি নয়। অর্থাৎ বিভিন্ন ডিগ্রির সঙ্গে ডক্টরেট লেখা থাকলেই সেটি পিএইচডি ডিগ্রি হবে তা বলা যায় না। আসলে বলা যেতে পারে সব পিএইচডি-ই ডক্টরাল ডিগ্রি, কিন্তু সব ডক্টরাল ডিগ্রি পিএইচডি নয়। যেমন—ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) এবং জুরিস ডক্টর বা ডক্টর অব জুরিসপ্রুডেন্স (জেডি), এসব ডিগ্রির সঙ্গে ডক্টর থাকলেও আসলে এগুলো পিএইচডি ডিগ্রি নয়। ডক্টর অব জুরিসপ্রুডেন্স (জেডি) আমেরিকা, কানাডাসহ কিছু দেশে আইন বিষয়ে প্রথম ডিগ্রি যা এলএলবি অনার্স ডিগ্রির সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার অনারারি বা সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিকেও পিএইচডি বলা যায় না। তাছাড়া কিছু প্রফেশনাল ডক্টরেট ডিগ্রি রয়েছে যা মৌলিক গবেষণামূলক ডিগ্রি হিসেবে গণ্য হয় না যদিও এদের নামের সঙ্গে ডক্টর শব্দ পাওয়া যায়। যেমন—ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন, এডুকেশন, মিউজিক, ফার্মেসি প্রভৃতি বিষয়ে প্রফেশনাল ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয় যা Doctor of Engineering (EngD), Doctor of Medicine (MD), Doctor of Education (Ed.D), Doctor of Musical Arts (DMA), Doctor of Pharmacy (PhamD), Doctor of Business Administration (DBA), Doctor of Social Science (DSS) ইত্যাদি নামে পরিচিত। দেশেভেদে বিভিন্ন বিষয়ে প্রফেশনাল ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। এসব ডিগ্রির সঙ্গে ডক্টর লেখা থাকলেও তাদের পিএইচডি বলা যায় না। 

তবে প্রফেশনাল ডক্টরাল প্রোগ্রামে কোর্স ওয়ার্ক, ক্লাস, প্রেজেন্টেশনসহ শেষে থিসিস জমা দিতে হতে পারে। এক্ষেত্রে  দেশ ও প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্নতা থাকতে পারে। কেউ কেউ প্রফেশনাল ডক্টরেট ডিগ্রিকে পিএইচডি ডিগ্রির সমতুল্য বিবেচনা করলেও বাস্তবে এদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে একসময় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার লাইসেন্স (License to teach) প্রদানকে বোঝানো হতো, তবে প্রফেশনাল ডক্টরেটকে অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞান বাস্তবে ব্যবহারের লাইসেন্স (License to practice) প্রদানকে বোঝানো হয়। PhD বা Doctorate ডিগ্রিধারী ব্যক্তি একজন পরিপূর্ণ এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত পেশাজীবী হবেন যিনি মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকতায় বা সৃজনশীল কাজে অথবা অন্যান্য গবেষণামূলক কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবেন। তবে দেশে-বিদেশে বর্তমানে এই ধারণার আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। 

পিএইচডি এবং প্রফেশনার ডক্টরেট ডিগ্রির মতো আর এক ধরনের ডক্টরেট রয়েছে যাকে Higher Doctorate বা উচ্চতর ডক্টরেট বলা হয়। প্রফেশনাল ডক্টরেটকে যেমন পুরোপুরি পিএইচডি বলা যায় না ঠিক তেমনি উচ্চতর ডক্টরেটও পিএইচডি ডিগ্রি নয়। উচ্চতর ডক্টরেটকে সম্মানসূচক ডক্টরেট বা Honorary Doctorate (honoris causa) বলা হয়ে থাকে, যার মর্যাদা বেশ ওপরে। যে ধরনের সম্মানসূচক ডক্টরেট দেখা যায় তাদের মধ্যে DS/SD (Doctor of Science), DLit/DLitt/LitD (Doctor of Letters/Literature), D.H.L (Doctor of Humane Letters), DD (Doctor of Divinity), DMus (Doctor of Music), DCL (Doctor of Civil Law), DLS (Doctor of Legal Science), LL.D (Legum Doctor/Doctor of Laws) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে কোনও কোনও দেশে LL.D, DCL পিএইচডি ডিগ্রির সমতুল্য বিবেচত হয়। সমাজে বা কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় অথবা নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ে যথা সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তার সম্মানে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি প্রদান করে থাকেন। যেমন—সমাজ সেবা, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বা সমাজে কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বা গবেষণা ও প্রকাশনায় দীর্ঘ অবদানের জন্য ডি.লিট/লিট.ডি/ডিএইচএল প্রদান করা হয়ে থাকে। ডি.লিট উপাধি সেই সব ব্যক্তিকে প্রদান করা হয় যাদের প্রকাশিত কাজ ও গবেষণার রেকর্ডে অদ্বিতীয় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব লক্ষ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি লাভ করেছেন। আবার সম্মানসূচক ডক্টরেট মরণোত্তরও দেওয়া যেতে পারে। যেমন—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মরণোত্তর ডি.লিট উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

শোষিত এবং নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য। মূলত যাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি দেওয়া হয়। এ ধরনের সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধির ক্ষেত্রে নামের আগে ‘ড.’ ব্যবহার করা হয় না। তবে বিশ্বেও বেশ কিছু উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট (Higher Doctorate) ডিগ্রি প্রদান করে না যেমন—ম্যাচাচুয়েটস ইসস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস (এলএসই), কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি। 

বাংলাদেশে প্রফেশনাল ডক্টরেট করার সুযোগ না থাকলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে থাকেন। গ্র্যাজুয়েশনের পরপরই যাদের পিএইচডি করার ইচ্ছা তারা বিদেশি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারেন। গ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ স্নাতকের পর  দেশে পিএইচডি করার সুযোগ নেই। 

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য মতে কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা দূরশিক্ষণের মাধ্যমে কোনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার অনুমতি নেই (ইউজিসি, ৭ মে ২০১৯ ইং)। দূরশিক্ষণের মাধ্যমে যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসব ভুয়া পিএইচডি সার্টিফিকেট কিনছেন তারা প্রতারিত হচ্ছেন মর্মে সম্প্রতি ইউজিসি জানিয়েছেন। আবার ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এ ধরনের একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আমেরিকা নামধারী অননুমোদিত বিভিন্ন ভূয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট ক্রয় করে অনেকেই তাদের নামের আগে ডক্টর পদবি ব্যবহার করে আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেছেন মর্মে প্রচার করতেও দেখা গেছে। 

এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ৭ মে ইউজিসি এক গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া (বাংলাদেশ স্টাডি সেন্টার) সহ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন দেশি-বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রির কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। মহামান্য হাইকোর্ট একটি রিট আবেদনে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে ইউজিসি’র আইন মানছে কিনা তা তদন্ত করে তিন মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। আবার একটি প্রতারক চক্র বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে, মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অফিস খুলে ৩-১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে বিশ্বের নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি সার্টিফিকেট বিক্রি করছে (বাংলা ট্রিবিউন, ৮ জানুয়ারি ২০১৭)। বলা হয়ে থাকে দেশে প্রায় ৫ হাজার বা তারও অধিক ভুয়া পিএইচডিধারী রয়েছে (যুগান্তর, ২২ জানুয়ারি ২০২০ ইং)। এমনকি ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় টাকার বিনিময়ে তৈরিকৃত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার শোনা যায় সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিকট পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ঢাকার সন্নিকটে দুয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো এসবের মাঝেও কি বাংলাদেশে কোনও ভালো গবেষণা হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে, যার সংখ্যা  নেহাত কম নয়। অনেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ  থেকে পিএইচডি করছেন। তাদের সবার পিএইচডি’র মান প্রশ্নের ঊর্ধ্বে কী! অনেকের অবজ্ঞাসূচক কথা শুনে মনে হয় দেশে পিএইচডি করা মানে সময়ের অপচয়। তবে হ্যাঁ, ইউজিসি বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে অনেকেই পিএইচডি নিয়ে ব্যবসা করছে। আবার অনেক সময় গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের অবহেলা বা গবেষককে পর্যাপ্ত সময় না দেওয়ার কারণেও খুব নিম্নমানের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অভিযোগও চোখে পড়ে। আসলে ভালো পিএইচডি বলতে যেটি বোঝায় তা অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান,গবেষকের দক্ষতা এবং সর্বোপরি গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের পাণ্ডিত্যের ওপরও নির্ভর করে। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে বিদেশে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো মানের পিএইচডি হয়। তবে ভিনদেশে পিএইচডি করার যোগ্যতা অনেকের থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাবে তাদের পক্ষে হয়তো তা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। সেজন্য দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি করা যেতে পারে। দেশে পিএইচডি গবেষণার মান বাড়াতে হলে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমস্যার গভীরে ঢুকে তা চিহ্নিতপূর্বক সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশেও ইতোপূর্বে ভালোমানের গবেষণা হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে বা এখনও হচ্ছে। তাদের গবেষণাকর্ম পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি সেসব গবেষক পরবর্তীতে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দেশে-বিদেশে গবেষণা কাজ পরিচালনা করেছেন বা এখনও করছেন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. গোলাম মুরশিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বিষয়ক অত্যন্ত উঁচু মানের একজন গবেষক এবং যিনি বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক বই লিখেছেন যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, আর সেটি হলো—মাতৃভাষা বাংলায় পিএইচডি করাকে অনেকেই বিদ্রুপের দৃষ্টিতে দেখেন। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশেই যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি না তাদের নিজ ভাষায় গবেষণা করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে ভালো গবেষণাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদও করা হয়েছে। যে ভাষার জন্য বাঙালি জাতি জীবন উৎসর্গ করেছে সেই ভাষায় গবেষণা করাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা উচিত। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় পিএইচডি অভিসন্দর্ভ সবার কাছে সহজে বোধগম্য হওয়ায় আপামর জনসাধারণ গবেষণা বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে। 

সবশেষে বলা যায়, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন মানেই গবেষণা থেকে বিদায়,তা কিন্তু নয়। গবেষণা জগতের প্রবেশদ্বার হলো পিএইচডি। এটিকে গবেষণার হাতেখড়ি বা সূচনাও বলা যায়। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর অনেকেই আর গবেষণা কাজে নিয়োজিত থাকেন না। সেক্ষেত্রে তাদের মূল উদ্দেশ্য নামের আগে উপাধি ব্যবহার করা। অনেকেই এ ধরনের পিএইচডিকে দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গেও তুলনা করে থাকেন। তাই দেশে-বিদেশে যেখানেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা হোক না কেন তৎপরবর্তীতে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা উচিত। শুধু নামের আগে উপাধি ব্যবহারই মুখ্য উদ্দেশ্য না হয়ে নীতি নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটিয়ে মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে নতুন নতুন জ্ঞানের সন্ধান দেওয়াই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিকে সজাগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।  

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ময়মনসিংহ।

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ