X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবারও তিন মোটরসাইকেল আরোহী!

হারুন উর রশীদ
২৭ মার্চ ২০১৬, ১২:৩৫আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৬, ১৫:৫৩

হারুন উর রশীদ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মিশন সমাপ্ত, তাসকিন শোক এবং ভারতের কাছে এক রানে হেরে যাওয়া নিয়ে আমরা যখন আবেগ, শোক আর আলোচনায় বুঁঁদ তখন বাংলাদেশে আবারও একটি ঘটনা ঘটে গেছে। সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে তবে গুরুত্ব পায়নি। আমরা এতই ক্রিকেট নিয়ে উন্মাতাল যে নজর দেওয়ার সময় পাইনি। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেছে। ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট হয়েছে।
মঙ্গলবার কুঁড়িগ্রামে হোসেন আলী (৬৫) নামে একজন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান মুক্তিযোদ্ধাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সকালে মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী তার নিজ বাসার পাশের রাস্তায় হাঁটছিলেন। এসময় একটি মোটরসাইকেলে আসা তিন দুর্বৃত্ত তাকে পেছন থেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর দুর্বৃত্তরা ককটেল ফাটিয়ে পালিয়ে যায়।
এবারও তিনজন মোটরসাইকেল আরোহী। এবারও কুপিয়ে হত্যা। এবারও ককটেল ফাটিয়ে পালিয়ে যাওয়া।
গত ছয় মাসে বিদেশি নাগরিক হত্যাসহ, ধর্মযাজক, পুরোহিত, ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তার মানুষ এবং পুলিশ হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে প্রতিটি ঘটনায়ই দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে গিয়ে হামলা চালায়। আর মোটরসাইকেলের আরোহী ছিল কমবেশি তিনজন। তাদের হামলার ধরনও এক। তারা কুপিয়ে বা জবাই করে হত্যা করেছে।
এবার আমি এই ঘটনাগুলোর একটু বিস্তারিত জানাচ্ছি আপনাদের-
মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীর আগে গত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করা হয়। হামলাকারী ছিল তিনজন এবং তারাও এসেছিল মোটরসাইকেলে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কে দুর্বৃত্তরা গুলি করে ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজারকে হত্যা করে। আর এখানেও হত্যাকারীরা আসে মোটরসাইকেল যোগে।
৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানি নাগরিক ওসি কোনিও হত্যাকাণ্ডও ঘটানো হয় একই স্টাইলে। এখানে ঘাতকরা মোটরসাইকেলে এসে হত্যার পর আবার মোটরবাইক যোগেই পালিয়ে যায়।

এর আগে ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীতে ফেইথ বাইবেল চার্চের যাজক লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। তিন যুবক মোটরসাইকেলযোগে ঈশ্বরদী বিমানবন্দর সড়কে ভাড়া বাসায় ঢুকে ধর্মগ্রন্থ পাঠ শোনার কথা বলে তার ওপর হামলা চালায়।

১৮ নভম্বের দুর্বৃত্তরা দিনাজপুরে খ্রিস্টান ধর্মযাজক পিয়ারো পারোলারি পচিমোকে হত্যার চেষ্টা করে। তিনজন মোটরসাইকেল আরোহী এ হামলা চালায়।

আর ৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশের ওপর হামলা এবং হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে তিন মোটরসাইকেল আরোহী। এখানে এক পুলিশ সদস্যকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এই হত্যাকাণ্ডগুলো বিশ্লেষণে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়:-

১. হত্যাকারীদের অপারেশনের ধরন একই- তারা মোটরসাইকেলে করে আসেন।

২. বাস্তবায়ন পদ্ধতিও এক। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে বা জবাই করেন।

৩. তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিদেশি বা ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তার মানুষকে হত্যা করেন।

৪. তারা গুলি ছুড়ে বা ককটেল ফাটিয়ে পালিয়ে যান।

আরেকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যা আমি পরে আলোচনা করবো। কারণ সেটা হত্যাকারীদের দাবি নিয়ে।

তবে হত্যাকাণ্ডের এই একই স্টাইলের বাইরেও সংখ্যালঘু এবং ভিন্ন ধর্মীয় চিন্তার মানুষ এবং স্থাপনায় হামলা এবং হত্যার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে।

২৩ অক্টোবর পুরনো ঢাকার হোসেনি দালানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলায় দুইজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হন।

২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মুসলমানদের একটি মসজিদে ঢুকে নামাযরতদের ওপর গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত এবং তিনজন আহত হন।

১০ ডিসেম্বর রাতে দিনাজপুরে কাহারোল উপজেলার জয়নন্দ গ্রামে ইসকন মন্দিরে ধর্মসভা চলাকালে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণে দুইজন আহত হন।

১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর দুটি মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় গ্রেনেড হামলায় অন্তত ছ’জন আহত হন।

২৫ ডিসেম্বর ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর দিন রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত হন।

এসব হত্যাকাণ্ড এবং হামলার জন্য পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থা এপর্যন্ত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমকিকে দায়ী করে আসছে। এমনকী জেএমবি আরও হত্যার পরিকল্পনা করছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকে হত্যার দিন মঙ্গলবারই সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা এপর্যন্ত তদন্তে দেখেছি এই হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র সদস্যরা জড়িত। সম্প্রতি তারা কয়েকজন ধর্মীয় পীর এবং আইনজীবীকে হত্যারও পরিকল্পনা করেছিল। ওই আইনজীবী রাষ্ট্র ধর্ম নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন।’

পুলিশ সোমবার রাতে এধরনের হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত চারজন জেএমবি সদস্যকে আটকও করেছে। আটক চারজন হলেন, আব্দুর রাজ্জাক উমায়ের, ফয়সাল আহম্মেদ, আহমেদ ফজলে আকবর ও আবু নাঈম মোহাম্মদ জাকারিয়া। তবে এই সব হতাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট কিছু বলেননি। তবে মনিরুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের কোনও নাশকতা বা হামলার শক্তি জঙ্গিদের নাই।

কিন্তু আমি বিষয়টি দেখতে চাই একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। আর এইসব হামলা এবং হত্যার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায়। নৃশংসতা দেখাতে চায়। শক্তির জানান দিতে চায়। এটা তাদের ড্রেস রিহারসেল।

আর তারা হামলা ও হত্যাকাণ্ডে যাদের টার্গেট করেন তার মাধ্যমে তারা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন। তারা ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ধর্ম, সমালোচনা এবং তাদের ‘আদর্শে’র বাইরে কিছুর অবস্থান সহ্য করতে চাইছেন না।

কিন্তু এই যে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড এটা আমার কাছে চূড়ান্ত কোন পর্যায় মনে হয় না। তারা তাদের অবস্থান এর মাধ্যমে সংহত করছে। তাদের মতের অনুসারী এবং সহানুভূতিশীলদের জানান দিচ্ছে, উৎসাহ যোগাচ্ছে এবং এবং এক ছাতার নিচে আনছে। এই এক ছাতার নিচে যে আনছে তা উদাহরণ দিয়েই স্পষ্ট করা সম্ভব।

বাংলাদেশে জঙ্গিদের একটি গ্রুপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বোমা ছুড়ে বা গুলি করে হত্যা। আর আরেকটি গ্রপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা জবাই করে হত্যা করে মিশন ‘কতল’-এর অংশ হিসেবে। জেএমবিকে বলা হয় বোমা-গুলি ব্যবহারকারী। আনসারুল্লাহ জবাই বা কুপিয়ে হত্যায় প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমরা যদি তাদের টার্গেট দেখি তাহলে সেখানে তাদের ভিন্নতা নেই। আর সম্প্রতি তাদের অপারেশন স্টাইলেও কিছু মিল পাওয়া যাচ্ছে। তাই আমার মনে বাংলাদেশের উগ্রবাদীরা এখন এক হচ্ছে। একই ছাতার নিচে এসে আরও শক্তিশালী হতে চাইছে। আর তার উদ্দেশ্য আরও বড় এবং ভয়াবহ।

প্যারিসের পর ব্রাসেলস-এ বোমা হামলা । ব্রাসেলস-এ হামলার দায় স্বীকার করছে আইএস। বাংলাদেশে সর্বশেষ ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীকেও হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এর আগেও তারা একইভাবে হত্যা হামলার দায় স্বীকার করে। এটি আরেবটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আমি বলছিনা এখানে আইএস আছে। বলছেন, সাইট ইন্টেলিজেন্স-এর রিটা কাৎস। আমি সাইট-এর তথ্যের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর আগে লিখেছিও। কিন্তু বাস্তবতা কোন দিকে যাচ্ছে তা এখন পর্যবেক্ষণ জরুরি। কারণ তারাতো থামছে না। থামছে না তাদের নৃশংস এবং টার্গেট ভিত্তিক হত্যাকাণ্ড।

কুঁড়িগ্রামের নিহত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী ১৭ বছর আগে স্বপরিবারে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। তার বয়স ৬৫ বছর। তাকে কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা বা পারিবারিক কোনও বিরোধের কারণে যে হত্যা করা হয়নি তা স্পষ্ট। তাকে হয়তো ধর্মত্যাগ এবং খ্রিস্টান হওয়ার কারণেই বলি হতে হয়েছে। এক বয়বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা যে কতটা নৃশংস হতে পারে তার জানান দিয়েছে। তাই এখনই আমাদের সাবধান হওয়া প্রয়োজন।

আমরা যদি এখনই সতর্ক না হই। আমরা যদি এগুলোকে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি। আমরা যদি আইএস থাকা না থাকার বিতর্কে সময় পার করি। তাহলে এরা তাদের ‘কতল’ মিশন আরও এগিয়ে যাবে। আর এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে ব্যক্তিই তাদের টার্গেট। তাদের টার্গেট আরও বড়। বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন তাহলে বুঝতে পারবেন তারা কোথায় নিয়ে যেতে চায় দেশটাকে।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ