কিয়েভের একটি প্রধান মহাসড়কের পাশের একটি হোটেলের পুড়ে যাওয়া অবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে ইসা আকাইয়েভ ব্যাখ্যা করছিলেন কীসের তাড়নায় তিনি নিজের মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী ইউনিট গড়ে তুলেছেন এবং ইউক্রেনের হয়ে লড়াই করছেন।
১৩ সন্তানের জনক ৫৭ বছর বয়সী আকাইয়েভ বলেন, আমি শুধু ক্রিমিয়ায় বাড়িতে ফিরতে চাই।
২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে আকাইয়েভ কিয়েভে চলে আসেন। এখানে আসার পর ক্রিমিয়া ব্যাটালিয়ন গঠন করেন। এটি ছোট একটি গোষ্ঠী, যাতে ক্রিমিয়ার তাতারদের সংখ্যা বেশি। তাতাররা হলো কৃষ্ণ সাগর উপত্যকার আদিবাসী তুর্কি মুসলিম জনগোষ্ঠী।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর কিয়েভ অঞ্চলে আকাইয়েভের ইউনিটের ৫০ জন যোদ্ধা লড়াইয়ে অংশ নেয়। কিন্তু এখন তারা ক্রিমিয়া সীমান্তের কাছাকাছি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন রণক্ষেত্রে লড়াই করতে চাইছে।
এই ক্ষুদ্র ইউনিটের লক্ষ্য হলো ক্রিমিয়াকে রুশদের কাছ থেকে মুক্ত করা। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতে খেরসন রুশ নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর তাদের এই লক্ষ্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। উপত্যকা থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের ১০০ কিলোমিটারের বেশি পিছনে ঠেলে দিয়েছে রুশ সেনারা।
কিন্তু তাতারদের দমিয়ে রাখার জন্য রুশদের এই অগ্রগতিই যথেষ্ট নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রুশ মুসলিম মিত্রদের ইউনিট। শততম দিনের দিকে গড়ানো যুদ্ধে মস্কো ধীর গতির অগ্রগতি অর্জন করছে, ফলে এই অগ্রগতি ঠেকাতে ইউক্রেনের যতসম্ভব বেশি লোক প্রয়োজন।
অনেক তাতার ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেছে। এই ঘটনার পর গণবিক্ষোভের মুখে ক্রেমলিনপন্থী ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
রাশিয়ায় সংযোজন
মস্কোর বিরুদ্ধে তাদের সন্দেহের শেকড় অনেক গভীরে। সোভিয়েত স্বৈরশাসক জোসেফ স্ট্যালিন ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ার তাতারদের গণ দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আকাইয়েভের দাদারা ছিলেন তাদের মধ্যেও। নাৎসি জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে স্ট্যালিন তাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়েছিলেন।
১৯৮০-র দশকে তাতারদের উত্তরসূরীরা ফেরার অনুমতি পায়। যেমন, ১৯৮৯ সালে উজবেকিস্তান থেকে ফিরেছেন আকাইয়েভ। অনেক তাতার সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে মুক্তি হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে।
মস্কোর অধীনে নতুন নিপীড়নের আশঙ্কায় ২০১৪ সালে কিয়েভে স্থানান্তর হন আকাইয়েভ। এখানে শুরুতে ইউক্রেনীয় নিরাপত্তাবাহিনী দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন।
‘এটি ছিল খুব কঠিন, অনেক মানুষ মুসলিমদের বিশ্বাস করে না, বিশেষ ক্রিমিয়ার তাতারদের। সবাই মনে করে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাড়া অন্য কিছু নই’, বলেন আকাইয়েভ।
কিন্তু ২০১৪ সালে পূর্ব ডনবাস অঞ্চলে যখন রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তখন পরিস্থিতি আমূল পাল্টে যায়।
ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বেচ্ছাসেবী ইউনিট হিসেবে নিবন্ধনের সুযোগ পায় তার ইউনিট। যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করে এবং তার ইউনিটের তিন যোদ্ধা আহত হন। গত মাসে তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পূর্ণাঙ্গ ইউনিট হতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
২০১৪ সালে আরও কয়েক ডজন স্বেচ্ছাসেবী ব্যাটালিয়ন গড়ে ওঠে এবং ইউক্রেনের অপ্রস্তুত সেনাবাহিনীকে ডনবাসে লড়াইয়ে সহযোগিতা করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে দুইটি চেচেন ইউনিট, একটি জর্জিয়ান ইউনিট এবং বেশ কয়েকটি ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ইউনিট। এগুলো বেশ কয়েকটি ইতোমধ্যে নিরস্ত্র হয়েছে, বাকিরা নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
রাশিয়া এসব ইউনিটের তিরস্কার করে আসছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ যুদ্ধ শুরুর আগে বলেছিলেন, কাঁধে বহনযোগ্য বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সাবেক স্বেচ্ছাসেবী ব্যাটালিয়নের হাতে তুলে দেওয়া প্রমাণ করে ইউক্রেনের সামরিক মনোবৃত্তি।
মার্চ মাসে ইউক্রেনের এক প্রেসিডেন্সিয়াল দূত বলেছেন, এখন এমন স্বেচ্ছাসেবী ব্যাটালিয়নের সংখ্যা শতাধিক। ইউক্রেন সরকার তাদের বীর হিসেবে মনে করে। বার্ষিক স্বেচ্ছাসেবী দিবসে তাদের অবদান ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়।
তাতার পরিচয়
আকাইয়েভের ব্যাটালিয়নের অর্ধেকের বেশি ক্রিমিয়ান তাতার। ক্রিমিয়ার জনগণের ১৫ শতাংশ তাতার জনগোষ্ঠীর।
২০০৪ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা এবং ইউনিটের ইমাম সেরহি বলেন, এই ইউনিটের মূল হলো ক্রিমিয়ান। কারণ তারা চায় তাদের উপত্যকাকে মুক্ত করতে। কিন্তু তাদের এমন কোনও নিয়ম নেই যে সদস্যকে ক্রিমিয়ান হতেই হবে।
ক্রিমিয়া মুক্ত করার ইউনিটের একটি লক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। যদিও এতে বেশ কয়েকজন রুশ নাগরিক রয়েছেন। ইউনিটের অমুসলিম সদস্যদের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে মদ পানে নিষেধাজ্ঞা।
রাশিয়ার উত্তর ককাস থেকে এক বছর আগে ব্যাটালিয়নটিতে যোগ দেওয়া কাবারদিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মুয়াজ বলেন, রুশ দখলদারিত্বে ক্রিমিয়ার তাতাররা অনেক বেশি নিপীড়িত হয়েছে। তাই তারা আমাদের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করে।
২০১৭ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাতারসহ ক্রিমিয়ায় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০১৬ সালে ক্রিমিয়া তাতারদের একটি সংগঠন মজলিস নিষিদ্ধ করে মস্কো। তারা জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা বলেছিল, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার রাশিয়ার যুক্ত হওয়ার গণভোট ছিল বৈধ।
আকাইয়েভ জানান, কিয়েভের ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ইয়াসনহোরোডকা নামের গ্রামে রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে তার ক্রিমিয়া ব্যাটালিয়ন শত্রুর শক্তি নির্ণয়ের অভিযান চালায়। পরে কাছে মতিঝিন গ্রামেও একই ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে।
অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্থানীয়রা শুরুতে আমাদের দেখে খুব ভয় পেয়ে যায়। কারণ তারা জানতো আমরা কারা। আমাদের চিৎকার করে বলতে হয়েছে, আমরা ইউক্রেনীয়। এরপর মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের বাড়ি বের হয়েছে, আমাদের চা পান করতে দিয়েছে।
আকাইয়েভ যে পুড়ে যাওয়া হোটেলের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তা তার কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। বলেন, আমরা এই জায়গাটি কিনতে চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম এখানে একটি ক্রিমিয়ান তাতার স্কুল ও মসজিদ তৈরি করব। কোনোভাবে তা আমরা পারিনি। এরপর এই অবস্থা হলো।
তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পটি আমার স্বপ্ন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি শুধু ক্রিমিয়ায় বাড়িতে ফিরতে চাই।’
সূত্র: রয়টার্স