X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর

বাখমুত দখল করলে কি ইউক্রেন যুদ্ধে জিতে যাবে রাশিয়া?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:৩৭আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৩, ১৪:২১

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণ এক বছর পূর্তির দিকে এগোচ্ছে। এমন সময় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনেস্ক অঞ্চলের শিল্প শহর বাখমুত যুদ্ধের তীব্রতম লড়াইয়ের একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

গত বছরের জুলাই মাস থেকে রুশ ও ইউক্রেনীয় সেনারা তীব্র সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। ২০২২ সালের গ্রীষ্মের পর বড় ধরনের জয় পেতে মরিয়া মস্কো। রুশ সেনারা পূর্বাঞ্চলীয় ডনেস্ক ও লুহানস্ক দখলের লক্ষ্যে অটল। দুটি অঞ্চল মিলে ভূখণ্ডটি ডনবাস হিসেবে পরিচিত। ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর দিকেই ডনবাস দখলের লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

বাখমুতের যুদ্ধে উভয়পক্ষে ব্যাপক প্রাণহানি হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন দিনগুলোর তীব্র লড়াই, বাখমুত ঘিরে সাম্প্রতিক সংঘাতের বৃদ্ধি এবং পাশের শহর সলেদার দখল মিলিয়ে এক বছর শুরু হওয়া আক্রমণে ইউক্রেনীয় সেনা হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে নিহত ও আহতের সংখ্যা অন্তত ১ লাখ হতে পারে।

বাখমুতের হতাহতের কথা এখনও জানা যায়নি। তবে ডিসেম্বরে ইউক্রেনের এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, শহরটি দখলের লড়াইয়ে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ রুশ সেনা নিহত হচ্ছে।

যুদ্ধ শুরুর আগে বাখমুতের জনসংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। এখনকার শহরটি যেনও আগের সেই বাখমুতের খোলস। ইউক্রেনীয় সংবাদমাধ্যম ইউক্রেনস্কা প্রাভদার তথ্য অনুসার, বাখমুতের ৯০ শতাংশ মানুষ পালিয়েছেন। কয়েক হাজার বাসিন্দা রয়েছেন যারা প্রতিদিন গোলাগুলি প্রত্যক্ষ করছেন। বাখমুতের প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাদের পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিখা যুদ্ধের কথা।

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বাখমুতের রণক্ষেত্রের পরিস্থিতি ‘খুব কঠিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এরপরও এখন পর্যন্ত শহরটি দখলে রাশিয়া কোনও কৌশলগত অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ।

ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকে পরিণত হয়েছে শহরটি। ‘বাখমুত অটল!’ ইউক্রেনীয় সেনা, তাদের সমর্থক, এমনকি জেলেনস্কির কাছে জাতীয় রণ-হুঙ্কারে পরিণত হয়েছে। এটি দখলে রাশিয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে যুদ্ধের আগামী দিনগুলো ইউক্রেনীয় সেনাদের মনোবল থাকবে অটুট।

এক ‘জীবন্ত দেয়াল’

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, কৌশলগত বিচারে বাখমুতের গুরুত্ব খুব সামান্য। কিন্তু তবুও তারা মনে করেন, পুরো ডনবাস অঞ্চল দখলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাশিয়া শহরটিকে ব্যবহার করবে।

ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলে আসছেন, বসন্তের মধ্যেই ডনেস্ক ও লুহানস্ক দখলের লক্ষ্য রয়েছে মস্কোর।

ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উপদেষ্টা আন্তন গেরাশেঙ্কো শুক্রবার বলেছেন, বাখমুত হলো একটি জীবন্ত দেয়াল। যা আমাদের দখল-বিরোধী প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। শহরটির একটি সফল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ফলে ইউক্রেনীয়রা পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো অবস্থায় যেতে পারবে। 

তিনি বলেন, এই অঞ্চল অভিমুখে রাশিয়া উল্লেখযোগ্য সেনা ও সরঞ্জাম হারিয়েছে। টানা কয়েক মাস ধরে তারা বাখমুত দখলের চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা কোনও সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

রাশিয়ার কাছে বাখমুত প্রতীকী অর্থে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন গেরাশেঙ্কো। তার কতায়, এই মুহূর্তে সেখানকার পরিস্থিতি খুব জটিল। কিন্তু আমাদের রক্ষকরা অনড় এবং তাদের লড়াইয়ের দায়িত্ব পালন করছে।

প্রতীকী জয়

যদি দখল করা সম্ভব হয় তাহলে রাশিয়ার জন্য তা হবে ২০২২ সালের গ্রীষ্মের প্রথম বড় লড়াইয়ে জয়। রাশিয়ার সেনাবাহিনী এবং ইয়েভজেনি গ্রিগোজিনের নেতৃত্বাধীন ভাড়াটে বাহিনী এমন কিছু চাইছে মরিয়া হয়ে।

লন্ডনভিত্তিক ঝুঁকি বিশ্লেষক অ্যালেক্স ককচারভ বলছেন, বাখমুত শহর পতনের কৌশলগত গুরুত্ব সামান্য। কিন্তু প্রতীকী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপক। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এটিকে একটি বড় হিসেবে হাজির করতে পারবেন। অন্তত রুশ সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে পারবেন পুতিন। বিপরীতে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি হয়ত মানসিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে পড়বেন।

তিনি বলেছেন, জুলাই মাস থেকে বাখমুতের কাছে একটি ছোট অঞ্চলে রুশ সেনাদের আটকে দিয়েছে ইউক্রেনীয়রা। ফলে রাশিয়া অন্যত্র সেনা মোতায়েন করতে পারছে না। শহরটি দখল করলে তা ডনবাস অঞ্চল দখলে রাশিয়ার যে লক্ষ্য রয়েছে তাতে সহযোগিতা করবে।

ককচারভ বলেন, রুশরা যদি বাখমুত দখলে সক্ষম হয় তাহলে তা রণক্ষেত্র আরও পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাবে, যা স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাটর্স্ক-এর কাছাকাছি। এতে করে ডনেস্ক অঞ্চলের উত্তরের অংশ ইউক্রেনীয় অবস্থান ঝুঁকির মুখে পড়বে।

এস্তোনিয়াভিত্তিক একটি থিংক-ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির গবেষক আইভান ক্লিসজ বলছেন, বাখমুত দখল করার পর রাশিয়া মোমেন্টাম তৈরি করতে পারবে কিনা, এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। বাখমুত হয়ত দখল হতে পারে। কিন্তু রাশিয়া যদি সেই জয় ধরে রাখতে না পারে, তাহলে ইউক্রেনীয় সেনারা অল্প দিনের মধ্যে তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে। যেমনটি সেভেরোডনেস্কতে ঘটেছে।

তিনি আরও বলছেন, বাখমুত দখল রুশদের বাসনায় পরিণত হয়েছে এবং তা অর্জনে একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে।

রুশ সেনাদের পাশাপাশি বাখমুতে ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে আক্রমণ করছে ওয়াগনার গ্রুপ। এই গ্রুপের অনেক যোদ্ধাদের রাশিয়ার কারাগার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা নৃশংসতার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ক্রেমলিন প্রিগোজিনকে পার্শ্ব চরিত্রে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাখমুত ঘিরে অভিযানে তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া হতে পারে। ধীরে ধীরে পুতিন ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের স্থলে পেশাদার সামরিক ব্যক্তিদের স্থলাভিষিক্ত করছেন।

আইভান ক্লিসজ বলছেন, বলা হচ্ছে যে রুশ সেনাবাহিনী থেকে নিজেদের ভাড়াটে বাহিনী যে শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণে প্রিগোজিন বাখমুত দখল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হওয়ায় এখন রুশ সেনাবাহিনী তাকে টেক্কা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

সুর পাল্টালেন প্রিগোজিন

বুধবার রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে প্রিগোজিন বাখমুত দখলের সম্ভাবনা নিয়ে নিজের নতুন প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেছেন। এতে তার প্রত্যাশার বদল স্পষ্ট। 

প্রিগোজিনের পর্যালোচনা মতে, মার্চ বা এপ্রিল মাস নাগাদ রাশিয়া বাখমুত শহর ঘিরে ফেলতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলছেন, বাখমুত ঘিরে ফেলা হয়েছে দাবি করে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সামর্থ্যকে খাটো করে দেখা উচিত হবে না রাশিয়ার।

তিনি বলেন, তাদের যদি ঘিরে ফেলা না হয় তাহলে কেন এমনটি বলা হচ্ছে? এক্ষেত্রে শত্রুদের খাটো করে দেখা উচিত না।

বাখমুত কেন রাশিয়ার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ?

যুদ্ধ শুরুর দিকে এটিকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ উল্লেখ করে পুতিন বলেছিলেন এর একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ডনবাস অঞ্চলকে ‘মুক্ত করা’। দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলটিতে রুশ ভাষাভাষী মানুষের বসবাস রয়েছে।

এক রুশ দূত বলেছেন, বাখমুত দখল যুদ্ধের গতি নির্ধারণ করবে। এই শহরটি একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। যেখানে রয়েছে মহাসড়ক। এসব মহাসড়ক ডনবাসের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর পর্যন্ত সংযুক্ত, যেমন- ক্রামাটর্স্ক ও স্লোভিয়ানস্ক।

জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার প্রথম উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি দিমিত্রি পলিয়ানস্কি বলেছেন, বাখমুত দখল করতে না পারলে ইউক্রেনে পুতিনের নির্ধারণ করে দেওয়া লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না রাশিয়া।

মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, আমি জানি বাখমুত দখল করা ছাড়া ডনবাস মুক্ত করার কোনও উপায় নেই। আমি জানি ডনবাসকে মুক্ত করা আমাদের সামরিক অভিযানের একটি লক্ষ্য।

যুদ্ধে বিধ্বস্ত শহরটিকে ‘ভারী প্রতিরক্ষা লাইনে একটি সুরক্ষিত একটি দুর্গ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন রুশ কূটনীতিক। তিনি বলেন, এটি কোনও সাধারণ শহর নয়। এই শহরের দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ ও সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এর ফলে এই দুর্গ দখল এত কঠিন। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমরা এটি দখল করতে পারব।

বুধবার সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টার্সসনের সঙ্গে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেনের ফ্রন্ট লাইনের মধ্যে বাখমুতের কাছে পরিস্থিতি সবচেয়ে কঠিন। কিন্তু ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার অগ্রগতি দৃঢ়ভাবে ঠেকিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, পূর্বাঞ্চলে আমাদের সেনাদের জন্য এটি কোনও সহজ কাজ নয়। তারা তো আর বিনা-কারণে এটিকে ‘বাখমুত দুর্গ’ বলছে না।

নিউজউইক অবলম্বনে।

/এএ/
টাইমলাইন: ইউক্রেন সংকট
সম্পর্কিত
ভারতের সঙ্গে সংঘাত বড় ধরনের আর্থিক প্রভাব ফেলবে না: পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী
পাকিস্তানকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি
হামাস এক জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার পর ইসরায়েল বলেছে-কোনও যুদ্ধবিরতি নয়
সর্বশেষ খবর
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
হাইকোর্টের রায়ে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল ইতিহাসে এটাই প্রথম: প্রধান বিচারপতি
হজ করতে সৌদি পৌঁছেছেন ৪০৬০৮ বাংলাদেশি, মৃত্যু ৬
হজ করতে সৌদি পৌঁছেছেন ৪০৬০৮ বাংলাদেশি, মৃত্যু ৬
ভারতের সঙ্গে সংঘাত বড় ধরনের আর্থিক প্রভাব ফেলবে না: পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী
ভারতের সঙ্গে সংঘাত বড় ধরনের আর্থিক প্রভাব ফেলবে না: পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী
ধনাগোদা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন, বিলীন হচ্ছে জমি-ঘর
ধনাগোদা নদীর কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন, বিলীন হচ্ছে জমি-ঘর
সর্বাধিক পঠিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি
পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে সহায়তা করবে বালুচ লিবারেশন আর্মি