X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একজন রূপবানের মৃত্যু

ফারজানা হুসাইন
২৯ এপ্রিল ২০১৬, ১১:০৯আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০১৬, ১১:১৩

ফারজানা হুসাইনপ্রথম সংবাদ পাওয়া গেল কলাবাগানের একটি বাড়িতে ঢুকে দুবৃত্তরা দুজন যুবককে খুন করে দিনের আলোয় সবার চোখের সামনে দিয়ে পলিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে শঙ্কিত হলো দেশের সবাই। তিনদিন হয়ে গেল, খুনি নিরুদ্দেশ এখনও। তবে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো নিহতদের পরিচয়। জানা গেল নিহত দুজনের মাঝে এক ব্যক্তির নাম জুলহাজ মান্নান। কে এই জুলহাজ মান্নান? তিনি ইউএসএইড-এর কর্মকর্তা। উচ্চশিক্ষিত উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীর মৃত্যুতে যারপরনাই উৎকণ্ঠিত আমরা। তার আরেকটি পরিচয় পাওয়া গেল তিনি ‘রূপবান’ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ‘রূপবান’ সমকামীদের অধিকার নিয়ে কথা বলে। ব্যস, আমরা আঁৎকে উঠলাম, ঘেন্নায় রি রি করে উঠলো শরীর! আমাদের উৎকণ্ঠ, দুঃখবোধ সব চুকেবুকে গেল। কারও সন্তান, ভাই, বন্ধু, প্রিয় সহকর্মী— জুলহাজ মান্নানের আর সব পরিচয়কে পেরিয়ে সমকামী হলো তার একমাত্র পরিচয়। আমরা নাক কুঁচকে যার যার কাজে মন দিলাম। লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সব মানুষের ভালোবাসার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যে মানুষটি কাগজ কলম হাতে কাজ করেছেন, সমাজের সিংহভাগ বিষমকামী তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের ভীড়ে লুকিয়ে থাকা কিছু মানুষের ভিন্নতর যৌন অভিযোজনের দরুণ অপ্রকাশ্য যন্ত্রণার কথা বলেছেন, সমকামিতার অপরাধে, সমপ্রেমীদের একত্রিত করার কারণে তার এহেন হত্যাকে আমরা মেনে নিলাম, এমনটাই তো যেন হওয়ার কথা ছিল। ধর্মপ্রাণ আমরা, আমাদের মানুষ পরিচয়কে হত্যা করে, আমাদের ভেতরের মানবিকতাবোধকে দাবিয়ে রেখে, ধর্মান্ধ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করলাম যেন। একই অনুভূতি প্রকাশ পেল  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের কথায়। দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রকাশিত খবর সূত্রে জানা যায়, মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানসহ দু’জন হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি জুলহাজ রূপবান নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আর তিনি সমকামীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতেন। এটা আমাদের সমাজের সঙ্গে মানানসই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আর আমিও আগেই বলেছি ,কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে বা বিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারও নেই। সবাইকে সংযত হয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করার অনুরোধ করছি ।’

আরও পড়তে পারেন: প্রধানমন্ত্রীকে জন কেরির ফোন
যৌন বা যৌনাচরণ সম্পর্কিত কোনও আলোচনা যে সমাজে এখনও ট্যাবু, সেখানে স্বেচ্ছায় সমকাম বা সমপ্রেমের দাবি মানবাধিকার নয় বরং প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত আচরণ আর আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ (পেনাল কোড ৩৭৭)। এই অপরাধে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও আর্থিক দণ্ড। ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল পেনাল কোডের এই ৩৭৭ ধারাকে সমকামীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এই ধারা পরিবতর্নে বারবার তাগাদি দিয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। কিন্তু সিংহভাগ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী দাবি করে সরকার ৩৭৭ ধারার মতো বৈষম্যমূলক এবং অস্বচ্ছ ধারাকে পরিবতর্ন করা থেকে বিরত থেকেছে। যা প্রকারান্তে রাষ্ট্র কতৃক সকল নাগরিকের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করার সাংবিধানিক অঙ্গীকারকে, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যূনতম মানবাধিকারের নিশ্চয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আমরা এমন একটি প্রজাতন্ত্রের নাগরিক, যে রাষ্ট্রের সংবিধানের চারটি মূলনীতি স্তম্ভের একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা, আবার অন্যদিকে সংবিধানের প্রারম্ভিকায় পরম করুণাময়ের নামে শুরু করার আহবান, সেই সংবিধানেই উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম । আমরা সংবিধান যদি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করি, তবে দেখতে পাব, আমাদের রাষ্ট্র ধর্ম (state law) ইসলাম, রাষ্ট্রের ধর্ম ( state's law) ইসলাম নয়। রাষ্ট্র একটি স্বকীয় সত্তা হলেও রাষ্ট্রের নিজের কোনও ধর্ম থাকতে পারে না। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সংবিধানের ২ ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্মের কথা উল্লেখ করার সাথে সাথেই আবার বলা হয়েছে ইসলামসহ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের ধমর্পালনের সমান মর্যাদা ও অধিকার রয়েছে। অপরদিকে সেক্যুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপাল বা মূলনীতি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিন্তু মূলনীতি নয়। উপরন্তু, সংবিধানের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বদলে বাংলাতে পরম করুণাময়ের নামে আরম্ভ করার আহবান সবর্জনীনতার প্রমাণ দেয়। সুতরাং পঞ্চোদশ সংশোধনীর পর বতর্মান সংবিধান রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম উল্লেখ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে শুধু এই একটি ধর্মের  মর্যাদাকে সমুন্নত রাখে না কিংবা শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালন নিশ্চিত করে না। বরং ধর্ম নিরপেক্ষতাকে মূলনীতি ধরে সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে সুনিশ্চিত করে।

আরও পড়তে পারেন: বেড়েছে সিসি ক্যামেরা বিক্রি
ধর্ম নিরপেক্ষতার যে পাশ্চাত্যের কাঠামো আছে, আমাদের প্রাচ্যের সেক্যুলারিজমের ধারণা সেই কাঠামো থেকে ভিন্নতর। ১৯৭২ সালের ১২অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে সংবিধানের মূল চার নীতির ব্যখ্যা করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। পঁচিশ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জোচ্চুরি,  বেঈমানি,  অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধমর্কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।
ধর্মবিশ্বাসকে যখন মানুষ হত্যার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন আমরা নিশ্চুপ কেন?

২. ছোটবেলায় সরকারী স্কুলে পড়েছি। তাই ছয়টাকা মাসিক বেতন, দুপুরে স্কুল থেকে দেওয়া সিঙ্গাড়া কিংবা বনরুটি খেয়ে, একই রঙের স্কুল ইউনিফর্ম পরে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গলা খুলে গেয়েছি—
মা তোর বদন খানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি,
আমার সোনার বাংলা।
আমি তোমায় ভালোবাসি।।
কিংবা স্কুল এসেম্বিতে দাঁড়িয়ে মানুষের সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখার যে শপথ করেছি, কখনও ভেবে দেখিনি এই মানুষ কি হিন্দু না মুসলমান, আস্তিক নাকি নাস্তিক, ধার্মিক না নীধর্মী। স্কুলের বাংলা, ইংরেজি, গণিত ক্লাসের পর যখন প্রিয় বন্ধুটি পাশ থেকে উঠে চলে যেত অন্য ক্লাসরুমে তখন বুঝতে শিখেছি ক্লাসটির নাম ধর্মীয় শিক্ষা, আমি আর আমার বন্ধুটি ভিন্ন। আমি মুসলমান, বন্ধুটি সংখ্যালঘু কোনও ধমর্গোষ্ঠীর। যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবোধ আমাদের মাঝে এক ও অবিচ্ছিন্ন বোধের জন্ম দিয়েছিল, ধর্ম শিক্ষার ক্লাসটি মোটা দাগে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ধর্মীয় শিক্ষার বই আমাদের শেখায় আমার ধর্ম সেরা, আমার বিশ্বাস সত্য ও শাশ্বত। স্বাভাবিকভাবেই অন্য ধর্মের বন্ধুটি আমাদের চোখে হয়ে যায় ভুল পথের যাত্রী। অথচ শিশুমনে এমন সংকীর্ণ বোধের জন্ম নাও হতে পারতো। ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতার শিক্ষা সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে একই ক্লাসরুমে বসিয়ে দেওয়া যেতে পারতো। যেমনটি দেওয়া হয় ইংল্যান্ডে। ইংরেজরা স্কুলের পাঠ্যসূচিতে রিলিজিয়াস এডুকেশন বা ধর্মীয় শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের জন্য ঐচ্ছিক করেছে। তবে প্রতিটি স্কুলে ধর্মীয়  শিক্ষা-বিষয়ের পাঠদানের সুযোগ রাখা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ, অভিভাবক বা শিক্ষার্থী ধর্মীয়  শিক্ষার ক্লাস বজর্ন করতে পারে কিন্তু শিক্ষার্থী চাইলেই স্কুল এই বিষয়ে শিক্ষা দিতে বাধ্য থাকবে। ইংরেজ স্কুলের ধর্মীয়  শিক্ষার পাঠ্যসুচিতে প্রচলিত ধর্মগুলোর মূলনীতি, প্রবর্তক, নৈতিক শিক্ষা সব ধর্মের শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়। এর ফলে ছেলেমেয়েরা সব ধর্ম বা ধমর্বিশ্বাসকে সম্মান করতে শেখে। তাদের মাঝে ধর্মান্ধতা জন্ম নেয় না। ধর্মনিরপেক্ষ অন্য রাষ্ট্রগুলোতে, যেমন ফ্রান্স কিংবা জাপান, অনেক ক্ষেত্রে ধমর্কে স্কুলের পাঠ্যসুচি থেকে বাদ দিয়ে শুধু নৈতিকতা বা মনুষত্বের শিক্ষাও দেওয়া হয়।
আরও পড়তে পারেন: চাপাতি রাজত্ব
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে শ্রেণিকক্ষে এ রকম সবর্জনীন ধর্মীয়  ও নৈতিক শিক্ষা যে আগামীদিনের সবর্জনীন ও শান্তিময় বাংলাদেশের জন্ম দেবে, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জীবন সুন্দর, প্রতিটি জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। আমরা যেন ভুলে না যাই, জীবনের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য জীবন নয়।

লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ