X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিকৃতির সংস্কৃতি  

মোস্তফা হোসেইন
২৮ মার্চ ২০২২, ২০:২১আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২২, ২০:২১
মোস্তফা হোসেইন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আবারও বলেছেন, বাংলাদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা– বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এই কথা বলেছেন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের সামনে। জোরালো না হলেও হাততালি পড়েছে একাত্তরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসে সেনানিবাসে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগিতায় বসবাস করা খালেদা জিয়ার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার ঘোষণার পর।

একাত্তরে বেগম খালেদা জিয়া ঢাকা সেনানিবাসে মুক্ত অবস্থায় দিনযাপন করেছেন। এমন কথা গত ৫০ বছর ধরেই মানুষ জেনে এসেছে। হঠাৎ করে কয়েক মাস ধরে বেগম খালেদা জিয়াকে কোন কারণে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। একসময় বিএনপি নেতারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানিরা বন্দি করে রেখেছিল। তিনি নির্যাতন ভোগ করেছেন, এমনটা প্রচার করে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করার কথাও বলা হয়েছিল। সেদিকটি হালে গুরুত্ব পাচ্ছে না বিএনপি নেতাদের কাছে। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব বললেন নতুন কথা। তার কাছ থেকে জানা গেলো চট্টগ্রামে বেগম খালেদা জিয়া মেজর জিয়াউর রহমানকে উদ্বুদ্ধ করে প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা প্রতিষ্ঠা করা কতটা সম্ভব হবে জানি না। কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য বেগম খালেদা জিয়া মার্চ মাসে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। যা তিনি নিজেও কখনও অস্বীকার করেননি। এটাও সত্য মানুষ যখন ঢাকা চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো থেকে পালিয়ে গ্রামে ও ভারতে যাচ্ছিল তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন। প্রথমে গুলশান ১ নম্বর একটি বাড়িতে অবস্থান করেন এবং মে মাসের ৮ তারিখ তিনি সেনানিবাসে স্বেচ্ছায় চলে যান।

প্রশ্ন আসতে পারে চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়াউর রহমান যখন ভারতে চলে যান তখন তিনি তার অবস্থান আগরতলায় গেলেন না কেন? খালেদ মোশাররফ, নুরুল ইসলাম শিশুর স্ত্রীরা ঠিকই তাদের স্বামীর কাছে গিয়েছিলেন? তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে শুধু গ্রামে আশ্রয় গ্রহণই নয়, ভারতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর প্রাদেশিক সদর দফতর ঢাকা সেনানিবাসে আসেন কেন?

পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়ার জন্যই কি তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছিলেন? তাও এমন সময় যখন সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছিল। যাক এসব প্রশ্ন বাদ দিয়েই দেখা যাক একাত্তরে ঢাকা সেনানিবাসে বেগম জিয়া কোন অবস্থায় কাটিয়েছেন এবং তিনি মুক্ত নাকি বন্দি ছিলেন।

নুরুল ইসলাম শিশু ও খালেদ মোশাররফ সাহেবের স্ত্রী যখন ভারতে চলে যান তখন জিয়াউর রহমানও চাইছিলেন তার পরিবারও ভারতে যাক। তিনি সেই উদ্যোগও গ্রহণ করেন। তিনি তিনবার মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানিদের দখলকৃত বাংলাদেশের প্রধান কেন্দ্র ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতে তার কাছে নিয়ে যেতে। তিনি যাননি। আর এই মিশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৬ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাতে। তৃতীয় দফায় মেজর জিয়াউর রহমান ক্যাপ্টেন গাফফারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন তার স্ত্রীকে যেন ভারতে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। গাফফার সাহেব বলেন, দ্বিতীয় দফায় বেগম খালেদা জিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে আসা ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রাণ দিতে হয়েছে, এরপরও কী উচিত হবে অন্য কোনও মুক্তিযোদ্ধাকে দেশে পাঠানো। শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের অনুরোধে ক্যাপ্টেন গাফফার সাহেব আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকায় পাঠান।মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ ঢাকায় জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রবেশ করেন। জানতে পারেন, এক সন্ধ্যায় খালেদা জিয়া হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টালে থাকবেন। একটি সেকসন মুক্তিযোদ্ধা যায় ইন্টারকনটিনেন্টাল মিশনে। তারা দেখতে পান, বেগম খালেদা জিয়া সুইমিংপুলের পাশে বসে আছেন। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারা জানান, মেজর জিয়াউর রহমান তাদের পাঠিয়েছেন খালেদা জিয়াকে ভারতে নিয়ে যেতে। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন কথা শোনার পর তিনি প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। তাদের হুমকি দেন, যদি তারা ওই মুহূর্তে হোটেল ত্যাগ না করে তাহলে তিনি পাকিস্তানি আর্মি ডেকে তাদের ধরিয়ে দেবেন। সুতরাং মেজর জিয়াউর রহমানের শেষ উদ্যোগ ব্যর্থ হয় বেগম খালেদা জিয়ার ভারত যেতে অনিচ্ছার কারণে।

পুরো এই ঘটনাগুলো ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দীন আহমেদ বীর উত্তমের বক্তব্যে পাওয়া যায়। যিনি প্রথম দফায় বুয়েটের আর্কিটেক্ট সানি এবং একজন ল্যান্স নায়েককে সঙ্গে নিয়ে মে মাসে ঢাকায় এসেছিলেন খালেদা জিয়াকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাকে সরাসরি জিয়াউর রহমান পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। সাহাবউদ্দীন আহমেদের এই ভাষ্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার হয়েছে। আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন। যা আমার কাছে ধারণকৃত অবস্থায় রয়েছে।

ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দীন আহমেদ বীর উত্তম মেজর জিয়াউর রহমানের কাছের মানুষ ছিলেন। যে কারণে তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে তার কাছে নিয়ে যেতে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। দু’জনই বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত। তিনি বলতে পারেননি স্বাধীনতা লাভের পর পর জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার মনোমালিন্য হওয়ার কারণ এটা কিনা।

বোঝা কঠিন, কেন বারবার খালেদা জিয়াকে ইতিহাস বিকৃতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর আগে ভুয়া জন্মদিন পালনের বিষয়টি তো শেষ পর্যন্ত আদালতেও গড়িয়েছে। এখন আবার তাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুনের আনন্দ করার উদ্দেশ্যে ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্ম তারিখ বানানো হয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে ১৫ আগস্টে কেক কাটা হচ্ছে না। ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির কতটা লাভ হয়েছে সেটা তারা বলতে পারবে। কিন্তু মানুষ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ নেতিবাচকভাবেই দেখেছে। এখন আবার খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টার পরিণতি কী হতে পারে তা কি বিএনপি ভেবে দেখেছে?

সর্বশেষ ২৭ মার্চ বিএনপি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সামনে সমাবেশ করার চেষ্টা করে। সেখানে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যগুলো ছিল সেই পুরনো রেকর্ড জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর চেষ্টা। শুধু তাই নয়, তারা সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে। আদালতের রায় অমান্য করাই শুধু নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তথ্য থাকার পরও তারা জোর করে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করে যাচ্ছে। উল্টো অন্যদের ইতিহাস বিকৃতকারী হিসেবে আখ্যায়িত করছে।

আসলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার মধ্য দিয়ে তাদের অর্জনটা কী হবে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্স কমান্ডার ছিলেন এটা কি অস্বীকার করছে? কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে কি এই তথ্য মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে? তারপরও তারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে কেন? মুক্তিযুদ্ধের ২৫/৩০ বছর পর হঠাৎ জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর চেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর হঠাৎ করে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা সুস্পষ্টভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যা ইতিহাস বিকৃতির সুস্পষ্ট লক্ষণ।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ