পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত না হয়ে স্থানীয় মানুষ, সময় ও স্থানকে তুলে ধরে বাংলা উপন্যাস সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা কথা সাহিত্যিকেরা। তাদের মতে, ‘সাহিত্য হতে হবে স্থানিক। সাহিত্যিককে স্থানীয় জায়গা ও মানুষকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। লেখক যেটা বুঝেছেন, সেটা অন্যদেরও বোঝাতে হবে লেখার মাধ্যমে।’
ঢাকা লিট ফেস্ট (ডিএলএফ) আয়োজনের তৃতীয় দিন আজ শনিবার আলোচনায় অংশ নিয়ে লেখকেরা বাংলা সাহিত্যের গঠন, নতুন ধরন নিয়ে তাদের ভাবনা তুলে ধরেন। ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের বই ‘উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে’ এর নামে আলোচনার বিষয়বস্তুর নামকরণ করা হয়েছে। আলোচনায় যুক্ত হন লেখক আনিসুল হক, শাহীন আখতার, মোহিত কামাল, জাকির তালুকদার এবং প্রশান্ত মৃধা। আলোচনা সঞ্চালনা করেন লেখক পারভেজ হোসেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘লেখকদের লিখেই যেতে হবে। প্রচলিত মূল্যবোধ, যেটাকে জ্ঞান–তথ্য–সত্য বলা হয় সেটাকে চ্যালেঞ্জ করা লেখকের কাজ। সেটা লেখককে করে যেতে হয়। এ দেশের সাহিত্য শুধু পশ্চিমের কাছ থেকে নিয়েছে, তা নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা এর বড় উদাহরণ।’
উপন্যাসের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ বইয়ের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘যারা হৃদয়ের কথা লিখেছেন, মনের কথা লিখেছেন সেগুলোকে কি বলবো? কেউ যদি শুধু নিজের সংকট নিয়ে লেখেন? তাই সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করে কিছু হবে না।’
উপন্যাসের নতুন ধরন প্রসঙ্গে আনিসুল হক বলেন, ‘একজন লেখক চরিত্র, সমাজ, সময়ের কথা নিজের মতো করে হাজির করতে পারলে এবং সেটা ভালো হলে তাই–ই নতুন। নতুন কিছু লেখার সহজ উপায় হচ্ছে ব্যঙ্গ–বিদ্রুপ নিয়ে লেখা। এই সমাজকে নিয়ে বিদ্রুপ করা ছাড়া কিছু করার নেই।’
শাহীন আখতারকে প্রশ্ন করা হয় তিনি এমন কিছু লেখার জন্য খুঁজছেন কিনা যেখানে আগে আলো পড়েনি। এর জবাবে শাহীন আখতার বলেন, তিনি নিজে লেখার সময় নতুন কিছু লিখতে হবে এমন ভাবনা নিয়ে লিখতে বসেন না। লেখার সময় হয়তো অন্য রকম হয়ে যায়। উপন্যাসের গঠন কেমন হবে সেটা নিয়ে তিনি ভাবেন। মানবিক জায়গা থেকে দেখেন চরিত্রগুলোকে। তিনি বলেন, ‘এদেশের সাহিত্য যেন পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রচিত না হয়, এদেশের দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে হয়। উপন্যাস অনেক ক্ষমতাধর মাধ্যম। সমাজ তৈরিতে উপন্যাস ভূমিকা রাখতে পারে।’
মোহিত কামাল বলেন, ‘তত্ত্বগতভাবে বিদেশি সাহিত্য থেকে উপাদান নেওয়া যাবে, তবে এদেশের উপন্যাস লিখতে হবে এদেশের উপযোগী করে। নতুনকে গ্রহণ করতে হবে, তবে সেটা হতে হবে নিজেদের মতো।’
তার সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের কথা তিনি উল্লেখ করেন, ‘যেখানে বাস্তব–পরাবাস্তব, চেতন–অবচেতন মন একাকার হয়ে গেছে।’
লেখায় নতুন কিছু দেখার ভঙ্গি প্রসঙ্গে জাকির তালুকদার বলেন, ‘উপন্যাসে নতুন ধরন আনার জন্য বিষয়বস্তুতে সঠিক আঙ্গিক দিতে হবে। যত গুরুত্বপূর্ণ লেখাই হোক না কেন, সঠিক আঙ্গিক না থাকলে তা উপন্যাস হয়ে ওঠে না।’
তিনি বলেন, ‘এখনকার মূল কাজ প্রচলিত ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করা। ব্রিটিশ আমলের দেশভাগের ইতিহাস খুব একতরফা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও বিকৃত হচ্ছে।’
প্রশান্ত মৃধা বলেন, ‘একসঙ্গে মিলে বাংলা উপন্যাসের নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ করতে হবে। নিজের মানুষের কথা লেখার বিষয়বস্তুতে তুলে আনতে হবে। উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজ করা উচিত, যে উপন্যাস আমাদের হয়ে উঠবে তা আরও বেশি করে সম্মিলিতভাবে করা দরকার। একটি প্রজন্মের অনেকে যার-যার মতো করে এক ধরনের ভাবনা নিয়ে লিখতে পারেন। যেটা ঘটেছে লাতিন সাহিত্যে।’