কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন। এ কারণে ১৫ দিন ধরে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে অন্তত ২৩ কোটি টাকা আয় হারিয়েছে মেট্রোরেল পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। একইসঙ্গে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন মেট্রোরেলে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যাত্রীরা। কবে নাগাদ মেট্রো চালু করা সম্ভব হবে সেটিও নিশ্চিত নয়। ফলে একদিকে মেট্রোরেলের লোকসান যেমন বাড়বে, অন্যদিকে যাত্রীদের ভোগান্তিও শিগগিরই দূর হচ্ছে না।
গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর মিরপুরের ১০ নম্বর গোলচত্বরে থাকা পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা। আগুনের কালো ধোঁয়া মেট্রোরেল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জননিরাপত্তার স্বার্থে ওইদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মেট্রোরেল বন্ধ ছিল। ওইদিন বিকালে দুর্বৃত্তদের হামলায় মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ নম্বর স্টেশনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ কারণে মেট্রোরেল বন্ধ রয়েছে।
গত ১০ মার্চ ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘মেট্রোরেলের দৈনিক আয় গড়ে দেড় কোটি টাকার মতো।’ সেই হিসাবে গত ১৫ দিনে ২৩ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
বন্ধ হওয়ার আগে মেট্রোরেলে দৈনিক গড়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার যাত্রী চলাচল করেছেন। ৪ লাখ ৫২ হাজার যাত্রী বহনের সক্ষমতা রয়েছে আধুনিক এই গণপরিবহনটির।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, লাভজনক হতে হলে মেট্রোরেলকে প্রতিদিন ৩ কোটি টাকার ওপরে আয় করতে হবে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্থার কর্মীদের বেতন বাবদ ২ কোটি টাকা ওপরে ব্যয় হবে। তবে এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল দৈনিক ৩ কোটি টাকা উপার্জনে পৌঁছাতে পারেনি।
মেট্রোরেল বন্ধ থাকায় দৈনিক ক্ষতির বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেলের আয়-ব্যয়ের হিসাব আন-অফিসিয়ালি বলা যাচ্ছে না। আমাদের সিএ ফার্ম আছে। তারা ভেরিফাই না করা পর্যন্ত আমাদের হিসাব নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না। তবে দৈনিক আয়ের বিষয়ে এর আগেও আমি সংবাদ সম্মেলনে বলেছি। সম্প্রতি আয় কিছুটা বেড়েছিল।’
ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ে কাজ চলছে
১৯ জুলাই দুর্বৃত্তদের হামলায় মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ নম্বর স্টেশনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। দুই স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য গত ২২ জুলাই মেট্রোরেল লাইন-৬-এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমটিসিএল। এই তদন্ত কমিটিকে পরবর্তী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
তবে প্রথম দুদিন কোনও কাজই শুরু করতে পারেনি এই কমিটি। প্রথম কার্যদিবসে (২৪ জুলাই) কূটনীতিকদের নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন পরিদর্শনে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। পরদিন ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৃতীয় কার্যদিবসে একটি প্রাথমিক সভা ও ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি পরিদর্শনের মাধ্যমে কাজ শুরু করে তদন্ত কমিটি।
কাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান মো. জাকারিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরুর দুদিন আমরা কোনও কাজ শুরু করতে পারিনি। তবে এখন পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এগোচ্ছি। প্রথমে স্টেশন দুটি পরিদর্শন করেছি। আমাদের কমিটিতে পরামর্শক, ঠিকাদার ও ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘কী কী ক্ষতি হয়েছে, সবাই মিলে তার তালিকা তৈরি করেছি। কোনগুলো সংস্কার বা নতুন করে কিনে এনে লাগানো হবে তা নির্ণয় করছি। এ কাজে আমাদের সময় লাগবে ।’
তিনি জানান, স্টেশন দুটির যেসব ক্ষতি হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে—টিকিট কাটার মেশিন, অফিস রুম, টিকিট পাঞ্চ করার গেট, কম্পিউটার, সিসিটিভি ক্যামেরা। এছাড়া আরও কিছু যন্ত্রপাতি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিরপুর-১০ স্টেশনের কর্মীরা। তবে মেট্রোরেল ও এর চলাচলের ভায়াডাক্ট অংশের কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানা গেছে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হবে। পরে যেসব যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়েছে, বিদেশ থেকে তা নতুন করে আনতে হবে এবং তা পুনঃস্থাপন করতে হবে। এতে এক বছর সময় লাগতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ স্টেশনের ই-সিস্টেমের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ সিস্টেম পুনরায় সচল করতে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা লাগতে পারে। কাজীপাড়া স্টেশনের ই-সিস্টেম অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে গেছে। এই স্টেশনের ই-সিস্টেম ঠিক হতেও ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ই-সিস্টেম ছাড়াও দুই স্টেশনে থাকা পাঞ্চ মেশিন, ভেন্ডিং মেশিন, বিভিন্ন ডিভাইস, কম্পিউটারসহ আরও যেসব জিনিসপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাও ঠিক করতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লেগে যেতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
কবে চালু হবে
বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ স্টেশন পরিদর্শন করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সভাপতি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, সদস্য মো. মুজিবুল হক ও আব্দুল্লাহ-আল-কায়সার পরিদর্শনে অংশ নেন।
পরে সংবাদ সম্মেলনে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, জনগণের কল্যাণেই মেট্রোরেলের মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সরকার গ্রহণ করেছে। কিন্তু নাগরিকের দুর্দশা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠী মেট্রো রেল, সেতু ভবন ও বিআরটিএ অফিসে হামলা করে। কমিটি ধ্বংসের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে দ্রুত মেট্রোরেল কীভাবে আবার চালু করা যায় সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করবে।
খোঁজা হচ্ছে হামলাকারীদের
মেট্রোরেলে হামলায় ও অগ্নিসংযোগে জড়িতদের খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যে অনেকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও তারা জানিয়েছে। এ ঘটনায় সম্প্রতি ছাত্রদলের নেতাসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, পরিকল্পিতভাবে মিরপুরে মেট্রোরেলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই হামলায় এক থেকে দেড় হাজার মানুষ অংশ নেয়। যারা এ হামলায় সরাসরি জড়িত ও নেতৃত্বদানকারী, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা, উত্তর) খোন্দকার নুরুন্নবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আন্দোলনের নামে যারা সহিংসতা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের মতো তাণ্ডব চালিয়েছে, এদের অনেককে আমরা গ্রেফতার করেছি। প্রতিদিনই আমরা এসব দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করছি। মেট্রোরেলে হামলা করা বাকিদেরও আমরা দ্রুতই আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করছি। জড়িত কাউকেই ছাড় দেবো না।’
আরও পড়ুন-
মেট্রোরেল কবে চালু হবে নিশ্চিত নয়: ডিএমটিসিএল
মেট্রোরেলের ২ স্টেশন এক বছরেও চালু করা সম্ভব নয়: ওবায়দুল কাদের
মেট্রোরেল স্টেশন চালুর জন্য জাপানের সহযোগিতা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী