কিশোরগঞ্জে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের সময় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসায় আগুন দিলে পুড়ে অঞ্জনা বেগম (৩২) নামে এক নারী ও তার ৭ বছরের কন্যাশিশু মারা গেছে।
ওই নেতার বাসার কাছে যুবলীগ নেতা মবিনকেও (৩৮) হাত-পা বেঁধে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তা ছাড়া সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে রুবেল আব্দুল্লাহ নামে (৫০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি শহীদী মসজিদের কাছে সংঘর্ষের সময় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
নিহত অঞ্জনা আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসার দারোয়ান আলম মিয়ার স্ত্রী। এ ঘটনায় আলম মিয়া ও তার ছেলে সাদেকও গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের বাড়ি সদর উপজেলার যশোদল গ্রামে। আহতরা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে সংঘর্ষ ও হামলায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। শুধু কিশোরগঞ্জ শহর নয়, পাকুন্দিয়া, করিমগঞ্জ ও কুলিয়ারচরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
শহরে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ও মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা সদর থানাতেও হামলা চালায় ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে।
রবিবার (৪ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে শত শত আন্দোলনকারী শহরের পুরান থানা এলাকায় অবস্থান নেয়। তাদের সবার হাতে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ছিল। এ সময় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
তখন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ পর দুপক্ষ মুখোমুখি হলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুরো কিশোরগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে কয়েক হাজার নেতাকর্মী স্টেশন রোডে অবস্থিত আওয়াম লীগ অফিসে হামলা চালায়। এ পর্যায়ে অফিসে আগুন দেয় তারা। ঘণ্টাখানেক সেখানে তাণ্ডব চালায় তারা। এ সময় বেশ কিছু গুলির শব্দও পাওয়া যায়। এ অবস্থায় আন্দোলনকারীদের একটি অংশ খরমপট্টি এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল ইসলামের বাসায় হামলা চালায়। তারা এ পর্যায়ে বাসার নিচতলায় রাখা অনেকগুলো গাড়িতে আগুন দেয়। তখন সৈয়দ টিটু বাসাতেই ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পাঁচতলায় পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম হন তিনি।
এ বাসায় অনেকগুলো পরিবারও ভাড়া থাকে। তখন ভাড়াটিয়াদের আর্তচিৎকারে লোকজন এগিয়ে এলেও ভয়ে তেমন কিছু করতে পারেননি। স্থানীয়রা বিভিন্ন বাসা থেকে পাইপ দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। পরে পুলিশ গিয়ে আটকে পড়াদের উদ্ধার করে।
পুলিশ জানিয়েছে, এ সময় আওয়ামী লীগ নেতার পাশের বাসার পেছন থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সদর উপজেলার কর্শ্বাকড়িয়াল ইউনিয়ন যুবলীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মবিনের লাশও উদ্ধার করা হয়। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘মূলত আমাকে হত্যা করতেই বাসায় হামলা করা হয়। আমি কোনোরকমে বাসার পাঁচতলায় একটি ছোট কক্ষে পালিয়ে জীবন রক্ষা করি। তাদের দেওয়া আগুনে আমার বাসার দারোয়ানের স্ত্রী ও তার সাত বছরের মেয়েশিশু আগুনে ঝলসে মারা যায়।’
শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘দুজন আগুনে পুড়ে মারা গেছে। আরেকজন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছেন।’
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ রাসেল শেখ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ বাসা থেকে আটকে পড়া কমপক্ষে ৩০ জন নারী-পুরুষকে উদ্ধার করে। আর দুজন হামলাকারীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যায়। বাসার পাশ থেকে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি যুবলীগ নেতা বলে জানা গেছে। এসব ঘটনায় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
এদিকে কিশোরগঞ্জ সদর থানাতেও হামলা চালানো হয়। ইটপাটকেলের আঘাতে থানার জানালার কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশ নিজেদের জানমাল রক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত পুরো শহরে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া হয় আন্দোলনকারীদের। পুলিশও নির্বিচারে টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
এ অবস্থায় পুরো শহর ভুতুড়ে পরিস্থিতি তৈরি হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পুরো শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল।
