কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আদালতে মামলার আবেদন করা হয়েছে। রবিবার (১৮ আগস্ট) রংপুরের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজু আহমেদের আদালতে মামলার আবেদন করেন আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী।
মামলাটি গ্রহণ করে বিজ্ঞ বিচারক অভিযোগটি হত্যা মামলার এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য রংপুর মেট্রোপলিটন তাজহাট থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন। যেখানে আসামি করা হয়েছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ১৭ জনকে।
মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন পুলিশের সাবেক আইজি আব্দুল্লাহ আল-মামুন, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, এএসআই আমীর আলী, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বেরোবি ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান, সহকারী কমিশনার আল ইমরান হোসেন, উপপুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন, বেরোবির প্রক্টোরিয়াল কর্মকর্তা রাফিউল হাসান, বেরোবির গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান, লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান মণ্ডল , বেরোবি পুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই বিভূতিভূষণ রায়, তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম, বেরোবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় রায়, দফতর সম্পাদক বাবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহফুজ।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, গত ১৬ জুলাই দুপুর পৌনে ২টার দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের কাছে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে উপপুলিশ কমিশনার মারুফ হোসেন এবং অন্যান্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফ হোসেন ও আল ইমরানের নেতৃত্বে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর ওই দিন দুপুর ১টা ৫৫মিনিটে সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফ ও আল ইমরানের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য আবু সাঈদকে বেরোবির ১ নম্বর গেটের বিপরীতে কাঠের পুলের নিকট হত্যার উদ্দেশ্যে বেধড়ক পেটায়। উপস্থিত কয়েকজন সংবাদকর্মী সেই দৃশ্যধারণ করতে শুরু করলে পুলিশ সদস্যরা আবু সাঈদকে সেখানে ফেলে চলে যায়।
একই দিন দুপুর অনুমান ২টা ১০ থেকে ২টা ২০ মিনিটে বেরোবি ক্যাম্পাস থেকে আসামি পোমেল বড়ুয়ার নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে আবু সাঈদ একাই পিছু না হটে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে সামনে এগিয়ে যায়। পুলিশ এ সময় ৫০-৬০ ফুট দূরে ছিল। এ সময় প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা রাফিউল হাসান হেলমেট পরে এসে আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে ‘গুলি করুন, গুলি করুন’ বলে জোরে জোরে বলতে থাকে। অপর দুই আসামি শিক্ষক মশিউর রহমান ও আসাদুজ্জামান মণ্ডল পুলিশকে বারবার গুলি করে হত্যার প্ররোচনা দিতে থাকেন। এ ছাড়াও ওই সময় হেলমেট পরা কয়েকজন শিক্ষক, পুলিশ পরিদর্শক, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা কোনও কারণ ছাড়াই নিরস্ত্র আবু সাঈদকে গুলি করতে পুলিশকে প্ররোচনা দিতে থাকেন।
একপর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে বেরোবির গেটের বাইরে এসে কোনও প্রকার সতর্কতা না দিয়েই ২০-২৫ ফুট দূর থেকে পুলিশ কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও এএসআই আমীর আলীসহ অন্যান্যরা আবু সাঈদের বুকে গুলি ছোড়েন। এ সময় সাক্ষীরা তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করলে সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরান নিজেই একজন পুলিশ সদস্যের শটগান দিয়ে গুলি করতে থাকেন। গুরুতর অবস্থায় সাঈদকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রায়হানুজ্জামান জানান, সারা দেশ এমনকি বিশ্ববাসী দেখেছে কীভাবে বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাত হিসেবে আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে থানাকে মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার আদেশ দিয়েছেন।
মামলার বাদী নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু দিন ধরে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কিন্তু পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় মামলা করা যায়নি।’ তিনি অভিযুক্ত আসামিদের সর্বোচ্চ দাবি করেন।