আপাতত ঠিক হয়েছে ১২ জন কাউন্সিল সদস্য থাকবে তালেবান সরকারের প্রাণকেন্দ্রে। কিন্তু প্রশাসনিক কাঠামো তো বিশাল। দেশ চালানোর মতো এত লোক আছে তালেবানের? শোনা যাচ্ছে, আগের সরকারের মধ্যে যারা তালেবানের প্রতি দিল-দরিয়া মনোভাব রাখে, তাদের দেওয়া হবে যার যার পছন্দের মন্ত্রণালয়। কেননা, নিজেদের দ্রুত একটি প্রশাসনিক রূপরেখায় আটকাতে চাচ্ছে একসময়কার ‘মোস্ট ওয়ান্টেড টেরোরিস্ট’ তালিকায় থাকা নেতারা। শীর্ষ নেতাদের কাছাকাছি থাকা কিছু সূত্র এমন তথ্য দিয়েছে ফরেন পলিসি ডটকমকে। আর এসব টুকরো তথ্য জোড়া লাগিয়েই পাওয়া যাচ্ছে নিকট ভবিষ্যতের তালেবান সরকারের রূপরেখা।
আগের মতো আর ‘প্রেসিডেন্ট’-এর মতো ‘বিলাসী’ পদ রাখতে চায় না তালেবান। তিন-চার জনের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা থাকবে, এমনটাও যেন না হয় এ জন্য ঘন ঘন চলছে বৈঠক। কেন এমন করছে তালেবানরা? উত্তরটা হলো, তারা বিশ বছর আগের প্রজন্ম নয়। আগের চেয়ে ঢের কূটনীতি বোঝে এবারের নেতৃত্ব। এ কারণে বড় একটা কাউন্সিলের চিন্তা করছে তারা। যেখানে পাঞ্জশির উপত্যকার তালেবানবিরোধী আন্দোলনকারীদেরও বলা হচ্ছে আলোচনায় বসতে, প্রস্তাব করা হচ্ছে কাউন্সিলের পদও।
ইতোমধ্যে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল নামে একটি পক্ষ কাজ শুরু করেছে। যার মূল আয়োজক হিসেবে আছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও সাবেক এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ। আছেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারও। তালেবান ও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধবাজ এ নেতার আঁতাত ছিল গভীর।
ভঙ্গুর অর্থনীতি ও অজস্র ক্ষুধার্ত মুখ তালেবানদের কিছুটা ধারণা দিয়েছে যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মূল্য কত। যার জন্য শুরু থেকেই ‘সাধারণ ক্ষমা’, ‘নারীরা কাজ করতে পারবে’, ‘নারীর প্রতি সম্মান দেখাতে তালেবান যোদ্ধাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ’- এসব শোনা যাচ্ছে বারবার। আড়ালে আবডালে কিছু প্রতিশোধ চললেও সেগুলো রাখঢাকে ঢের সচেষ্ট এখনকার তালেবান নীতিনির্ধারকরা।
কাউন্সিল সরকার গঠন সম্পূর্ণ না হলেও এখনও মূল নেতৃত্বে আছেন তিন জন- তালেবানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার, মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব (মোল্লা উমরের ছেলে) ও সাম্প্রতিক সফল যুদ্ধকৌশলের মূল নকশাকার মোল্লা মোহাম্মদ ওমর। এদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠবস করছেন খলিল হাক্কানিও। ২০ বছর ধরেই যিনি নানা জঙ্গি হামলার নকশাকার, জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত। আর আস্ত একটি দেশের যাবতীয় বাণিজ্য থেকে শুরু করে লিথিয়াম, মারবেল ও রত্নপাথরসহ বাকি সব খনিজ এখন বলতে গেলে এই তিন জনের হাতেই।
ওই তিন নেতার কাছের এক সূত্র ফরেন পলিসিকে জানালো, আহমদ মাসুদকেও কাউন্সিলে টানতে চেয়েছেন বারাদার ও ইয়াকুব। এই আহমদ মাসুদ হলেন তালেবানবিরোধী নেতা আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে। নাইন-ইলেভেনের দুদিন আগে আহমদ শাহ মাসুদ মারা যান আল কায়েদার হাতে। কিন্তু মাসুদ এ আহ্বানে সাড়া দেবেন না বলেই জানেন সবাই। কাবুলের ১০০ মাইল দূরের পাঞ্জশির উপত্যকায় তিনি ও তার দলবল এখনও নিজেদের এলাকা দখলে রেখেছেন।
পাঞ্জশির ঘটনায় কিছুটা আঁচ করা যায় যে, সদ্য ক্ষমতায় আসা তালেবান কাউন্সিল শক্ত-সামর্থ্য না হলে দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদে একটি গৃহযুদ্ধ আসন্ন। বাগলান, তাখার ও কাপিসা প্রদেশ থেকে এরইমধ্যে বিচ্ছিন্ন হামলা-পাল্টা হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সাবেক এক আফগান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।
তালেবান মানে কিন্তু একটি জাতিসত্তা নয়। এদেরও আছে গোত্রভেদ। আর সেসব নিয়েও চুলচেরা অঙ্ক কষতে হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের। দক্ষিণের পুরনো দল ও পশতুভাষী তালেবানরা এরইমধ্যে নতুন প্রজন্মের উজবেক ও তাজিক তালেবান নেতাদের হাতে ঝাণ্ডা তুলে দিয়েছেন। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত আগ্রাসী বাহিনী হাক্কানি গ্রুপের হাতে আছে কাবুল প্রতিরক্ষার মূল দায়িত্ব। হাক্কানিদের ‘বাড়াবাড়ি’ আচরণ আবার পছন্দ হচ্ছে না কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা মোল্লা বারাদারের অনুসারীদের।
আপাতত, আফগানিস্তানের সাবেক সরকার ও তালেবানের বর্তমান শাসক- দুপক্ষের সূত্রই ফরেন পলিসিকে বলেছে, সবাই এ ব্যাপারে একমত যে তালেবানরা কাগজে-কলমে যে ফর্মুলাই হাজির করুক না কেন, সেটাকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মহলকে কমপক্ষে তিন মাস অপেক্ষা করতেই হবে। এরমধ্যে আবার বিশ্বকর্তারা নির্বাচনের শর্ত জুড়ে না দিলেই হলো। কারণ, নির্বাচন সম্পর্কে ধারণাই নেই তালেবানের। তারা জানে নির্বাচন হলে জিতবেও না।
সূত্র: ফরেন পলিসি